বৃহস্পতিবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৯, ০১:১৮:২৬

নভেম্বর থেকে জম্মু-কাশ্মীর আর রাজ্য থাকবে না, হবে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে দুটি অঞ্চল

নভেম্বর থেকে জম্মু-কাশ্মীর আর রাজ্য থাকবে না, হবে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে দুটি অঞ্চল

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ৩১ অক্টোবর, মানে নভেম্বর থেকে জম্মু-কাশ্মীর ভারতের রাজ্য থাকবে না। গত সপ্তাহে ভারতের সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সিদ্ধান্ত হয় যে, কাশ্মীরকে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে দুটি অঞ্চলে বিভক্ত করা হবে। একটি জম্মু-কাশ্মীর এবং অপরটি লাদাখ।

ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলো রাজ্যগুলোর চেয়ে অনেক কম স্বায়ত্তশাসন ভোগ করতে পারে এবং ওই অঞ্চলগুলো সরাসরি দিল্লির শাসনাধীন। এ বিভক্তির ফলে সেখানকার প্রায় ৯৫ শতাংশ মানুষের ঠিকানা হবে জম্মু-কাশ্মীর অঞ্চলে। এটি দুটি অঞ্চল নিয়ে গঠিত। একটি হচ্ছে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীর উপত্যকা এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু।

বাকি ৫ শতাংশ মানুষের বসবাস হবে নতুন তৈরি হওয়া কেন্দ্রশাসিত পাহাড়ি অঞ্চল লাদাখে, যেখানকার জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মুসলিম এবং অর্ধেক বৌদ্ধ। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীর উপত্যকার জনসংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ এবং জম্মুর জনসংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ। লাদাখের জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩ লাখ।

অনুচ্ছেদ ৩৭০ বিলোপের এই দাবিটি ১৯৫০-এর দশক থেকেই ডানপন্তীদের অন্যতম প্রধান একটি দাবি ছিল। তারা ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যকে তুষ্ট করে চলার উদাহরণ হিসেবে সাত দশক ধরে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০-এর সমালোচনা করে আসছে।

কাশ্মীরে নব্বইর দশকে সশ'স্ত্র উগ্রবাদের উত্থান হওয়ার পর সেখান থেকে লক্ষ লক্ষ কাশ্মীরি পন্ডিতদের প্রায় সবাইকেই সপরিবারে জোরপূর্বক বের করে দেয়া হয়। এরপর থেকে কাশ্মির প্রায় অশান্ত থাকতে দেখা যায়। ভারতের সরকার এর পিছনে পাকিস্তানের মদত রয়েছে বলে জানিয়ে এসেছে।

২০০২ সালে রাষ্ট্রীয় সমাজসেবক সংঘ (আরএসএস) দাবি করেছিল কাশ্মীরকে তিন ভাগে বিভক্ত করার: হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু রাজ্য, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীর রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত লাদাখ অঞ্চল। আরএসএস হিন্দুত্ববাদী আন্দোলনের প্রধান আহ্বায়ক হিসেবে কাজ করে।

অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিলের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দাবি করেন, কাশ্মীরকে স্বায়ত্বশাসন দেয়া ওই অনুচ্ছেদই সেখানে 'বিচ্ছিন্নতাবাদ' তৈরি করার পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। অনুচ্ছেদ ৩৭০-এর কারণে পাওয়া স্বায়ত্বশাসনের অধিকার অবশ্য ১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশকেই কেন্দ্রীয় সরকারের বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্তের জন্য বেশ খর্ব হয়।

১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ের পর অনুচ্ছেদ ৩৭০-এর যতটুকু কার্যকর ছিল তার সিংহভাগকেই প্রতীকি বলা চলে। রাজ্যের একটি আলাদা পতাকা, ১৯৫০-এর দশকে তৈরি করা একটি রাজ্য সংবিধান, যেটি একতাড়া কাগজের বেশি কিছু নয় এবং রাজ্যের বিচারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য কাশ্মীরের পেনাল কোডের অবশিষ্টাংশ, যেটি ১৮৪৬ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত কাশ্মীরের জন্য কার্যকর ছিল।

কাশ্মীরের বাইরের মানুষ সেখানে সম্পত্তির মালিকানা লাভ করতে পারতো না এবং কাশ্মীরিদের চাকরির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার থাকতো যেই অনুচ্ছেদের সুবাদে সেই অনুচ্ছেদ ৩৫-এ তখনো কার্যকর ছিল। তবে এই আইন যে শুধু জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যেই বলবৎ ছিল তাও নয়।

উত্তর ভারতের রাজ্য হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখন্ড ও পাঞ্জাব বাদেও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অনেক রাজ্যের বাসিন্দাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এ ধরণের আইন কার্যকর রয়েছে।

কাশ্মীর রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদ এর আসল কারণ ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে রাজ্যটির স্বায়ত্বশাসন কার্যত অকার্যকর করে ফেলা এবং তার ফলস্বরুপ তৈরি হওয়া পরিস্থিতি। কাশ্মীর রাজ্যের নেতৃত্বে দিল্লির প্রভাব তখন থেকেই ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করে। পাশাপাশি প্রাগৈতিহাসিক আইন কার্যকর করে কাশ্মীরকে একটি পুলিশ ও সেনা নিয়ন্ত্রিত রাজ্যে পরিণত করে ভারত।

তবে এখন জম্মু ও কাশ্মীরের কাছ থেকে রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নেয়ার মাধ্যমে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করলো যা স্বাধীনতা উত্তর ভারতে কখনো হয়নি।

ভারতে যে রাজ্যগুলো রয়েছে সেগুলো যথেষ্ট স্বায়ত্বশাসন ভোগ করে। আর ভারতে যে সাতটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলো রয়েছে ৩১ অক্টোবর থেকে তা ৯ টিতে পরিণত হবে। এগুলো কার্যত তেমন কোনো স্বায়ত্বশাসন ভোগ করার অধিকার রাখে না।

ধারণা করা হচ্ছে, হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএস ও ভিএইচপি ২০০২ সালে যে রকম প্রস্তাব করেছিল তার আলোকে কাশ্মীরের কাঠামোতে আরো পরিবর্তন আসতে পারে। এর ফলে ওই অঞ্চলের হিন্দু ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে দূরত্ব আরো বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে মনে করা হচ্ছে।

পশ্চিম লাদাখের কারগিল অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ করা শিয়া মুসলিমরা কেন্দ্রশাসিত লাদাখ অঞ্চরের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বিষয়টিকে সহজভাবে নিয়েছে, সেই বৌদ্ধরা এই আইনকে স্বাগত জানিয়েছে। লাদাখের এমপি সেরিং নামগিয়াল এর সমর্থনে লোকসভায় জোরাল বক্তব্য রাখেন।

জম্মু-কাশ্মীরের ন্যাশনাল কনফারেন্স এবং পিপলস ডেমোক্রাটিক পার্টিকে আক্রমণ করে তিনি বলেন, দুই পরিবারের সদস্যরা ক্ষমতার নেশায় মত্ত। তারা কাশ্মীরকে নিজেদের সম্পত্তি বলে মনে করেন। নির্বাচনে লাদাখ এবং কার্গিলের মানুষ জাতীয় অখণ্ডতার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। ওই অঞ্চলের মানুষ লাদাখকে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল হিসেবে দাবি করেছিলেন। 

ভারত শাসিত কাশ্মীরে অতিরিক্ত প্রায় ৩০ হাজার সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। পূর্ব লাদাখের লেহ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ করা বৌদ্ধরা এবং জম্মুর হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীও তাদের বিশেষ মর্যাদা হারানোর বিষয়টিতে খুশি।

মোদি ওই অঞ্চলের মানুষের জন্য উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে ভরপুর এক ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু ও কাশ্মীরের গঠনতন্ত্র তৈরি করার জন্য শিগগিরই একটি নির্বাচন আয়োজন করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। 

তবে, এ ধরণের কোনো নির্বাচনের আয়োজন করা হলে তা কাশ্মীর এবং জম্মুর মুসলিমরা গ্রহন করবে কি প্রত্যাখ্যান করবে এটা বলা যাচ্ছে না। ফলে, ওই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে কার্যত একটি বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার ব্যবস্থা তৈরি হবে।

ভারতের আগের যে কোনো সরকারের কেন্দ্রভিত্তিক বা কর্তৃত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের সাথে তুলনা করলে বর্তমান সরকারের কাশ্মীর সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের দু'টি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।

প্রথমত, এর আগে কেন্দ্রীয় সরকার সবসময় আঞ্চলিক রাজনীতিবিদদের ওপর নির্ভরশীল ছিল। সাধারণত তারা ছিলেন কাশ্মীর অঞ্চলের অভিজাত রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য। কিন্তু এখন মোদি এবং অমিত শাহ সেসব রাজনৈতিক প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যদের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে অধিষ্ঠিত না করে অতি কেন্দ্রীয় একটি ধারার দিকে হাঁটছেন।

দ্বিতীয়ত, ১৯৫০ সালের পর থেকেই জম্মু ও কাশ্মীরে চলা ভারতের নীতিকে সমর্থন করে আসা হয়েছে অদ্ভূত একটি যুক্তির মাধ্যমে। তা হলো, ভারতের 'ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র' হওয়ার দাবিকে ন্যায়সঙ্গতা দেয়ার জন্য যে কোনো মূল্যেই হোক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরকে ভারতের অন্তর্ভূক্ত থাকতে হবে। তবে নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ এ ধরণের খোঁড়া যুক্তিতে বিশ্বাসী নন।

কাশ্মীর ইস্যুতে নেয়া সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের কারণে অক্টোবরে হতে যাওয়া ভারতের কয়েকটি রাজ্যের নির্বাচনে বিজেপি লাভবান হবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। কিন্তু কাশ্মীর নিয়ে বিজেপির কট্টরপন্থী সিদ্ধান্ত ওই অঞ্চলের অর্ধ-শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে চলতে থাকা দ্বন্দ্বকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী? সেটা দেখার বিষয়।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে