রবিবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০২০, ০৭:২৮:৫৩

ইরাকে অন্ধকারের মধ্যে মার্কিন সেনাদের ভবিষ্যৎ

ইরাকে অন্ধকারের মধ্যে মার্কিন সেনাদের ভবিষ্যৎ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : 'আসছে, আসছে,' ইরাকের রাজধানী বাগদাদে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনীর ঘাঁ'টিতে লাউডস্পিকারে রকেট হা'মলার ব্যাপারে স'ত'র্ক সং'কে'ত বেজে উঠেছে। এই এলাকাটি হচ্ছে গ্রিন জোন, যা একসময়ের ইরাকি নেতা সাদ্দাম হোসেনের প্রাসাদ এবং আশেপাশের এলাকা নিয়ে গঠিত হয়েছে।

প্রথম স'ত'র্ক সং'কেতের কয়েক সেকেন্ড পরে দুইটি বড় বি'স্ফো'রণের শব্দ শোনা গেল। এরপরে আরেকটি ঘোষণা শোনা গেল, ঘাঁ'টির সবাইকে নিরা'পদ অবস্থানে যাওয়ার জন্য বলা হচ্ছে। এসব কাতিয়ুশা রকেটের ল'ক্ষ্য সম্ভবত একটু দুরের মার্কিন দূতাবাসটি। 

একঘণ্টা পরে জানানো হলো যে, সবাই এখন নিরা'পদে বেরিয়ে আসতে পারেন। একটি রকেট কাছের টাইগ্রিস নদীতে পড়েছে, কিন্তু দুইটি রকেট পড়েছে দূতাবাস চত্বরে। ৪২ বছর বয়সী বেসামরিক একজন ব্যক্তি পারি, যিনি এই ঘাঁ'টিতে একজন ক্ষৌ'রকার হিসাবে কাজ করেন। তিনি বলেন, ''এটাই প্রথমবার নয়, আর এটা শেষবারও হবে না।''

একসময় তিনি আফগানিস্তানের কাবুলে মার্কিন ঘাঁটিতে কাজ করতেন, কিন্তু সেটা খুব বি'প'জ্জনক হয়ে ওঠায় তিনি সেখান থেকে চলে আসেন। সবাই তাকে বলেছিল যে, বাগদাদে তিনি অনেকটা শান্তির জীবন কাটাতে পারবেন। কিন্তু প্রথম যেদিন তিনি দূতাবাসে কাজ করতে আসেন, সেদিন রাতেই দুটি রকেট হা'মলা হয়।

২০১৯ সালের অক্টোবর মাস থেকে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের ল'ক্ষ্য করে ১০৯টি কাতিয়ুশা রকেট হা'মলা হয়েছে। জোট বাহিনী বলছে, ইরান সমর্থিত আধা-সামরিক গ্রুপগুলো এই হা'মলা করছে। এরপরে ৩ জানুয়ারিতে ঘটল বাগদাদ বিমানবন্দরের কাছে ইরানি জেনারেল কাসেম সোলেইমানি হ'ত্যাকা'ণ্ডের ঘটনা, যিনি ছিলেন ইরানের কুদস বাহিনীর প্রধান।

পাঁচদিন পরে ইরাকে মার্কিন ঘাঁ'টিতে মিসা'ইল হা'মলা করে জবাব দেয় ইরান। এই হা'মলার ফলে ইরাকে যেসব জোট বাহিনীর ঘাঁ'টিতে মার্কিন সেনা রয়েছে, সেসব ঘাঁ'টি নতুন করে নিরা'পত্তা নিয়মনীতি তৈরি করতে বাধ্য হয়। ঘাঁ'টির বাইরে সকল কর্মকাণ্ড এখন নি'ষি'দ্ধ এবং সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত প্রকাশ্যে চলাফেরার ক্ষেত্রে প্রতির'ক্ষামূলক জিনিসপত্র ব্যবহার করতে হয়।

ইসলামিক স্টেট গ্রুপের বি'রু'দ্ধে লড়া'ইয়ের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সঙ্গে অনেক অভিযানে অংশ নিয়েছি এবং ইরাকে তাদের অনেক ঘা'টিতে গিয়েছি। আমাকে বলা হয়েছিল, ঘা'টির ভেতরে শরীরব'র্ম পড়ার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ এখানে আমি নিরা'পদ। কিন্তু গতবারে এসে ইউনিয়ন থ্রি ঘাঁ'টি আমি যেমন দেখেছি, সে তুলনায় এখন অনেক বেশি খালি।

জোট বাহিনীর অনেক সদস্যকে, নেটো সৈনিকরাও যাদের মধ্যে আছে, পার্শ্ববর্তী কুয়েতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কর্মকর্তারা আমাকে জানিয়েছেন, যখন হু'মকি কমে আসবে, তখন আবার সৈনিকদের এখানে ফিরিয়ে আনা হবে। কিন্তু মার্কিন কর্মকর্তারা অনুভব করছেন, সোলেইমানি হ'ত্যাকা'ণ্ডের পর সেখানকার পরি'স্থিতি আরো জ'টিল এবং গভীর হয়ে উঠছে।

ইউনিয়ন থ্রি বেস হচ্ছে আইএসের বি'রু'দ্ধে ল'ড়াইয়ে ইরাকি ও জোট বাহিনীর প্রধান ঘাঁ'টি। যখন আগেরবার আমি এখানে ছিলাম, মার্কিন এবং ইরাকি কর্মকর্তারা মিডিয়ার কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন যে, তাদের সম্পর্ক পেশাগত এবং ব্যক্তিগতভাবে কতটা গভীর।

উভয় পক্ষই ক্যামেরার সামনে এসে আইএস দ'মনে তাদের যৌথ লক্ষ্যের কথা বলতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু এখন জোট কর্মকর্তারা ক্যামেরার সামনে কিছু বলতে অ'স্ব'স্তি বোধ করছেন। একসময়ে যা চমৎকার বন্ধুত্ব ছিল, সাম্প্রতিক ঘটনাবলী তার ওপর ছায়া ফেলতে শুরু করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ড্রো'ন হা'মলায় জেনারেল সোলেইমানির সঙ্গে আরো নিহ'ত হয়েছিলেন ইরান-প'ন্থী প্যারা মিলিটারি বাহিনীর উপ-প্রধান, আবু মাহদি আল-মুহানদিস। মজার ব্যাপার হলো, তার মৃ'ত্যুর কয়েকদিন আগেই তিনি বাগদাদের এই গ্রিন জোনে ছিলেন।

তার শিয়া মুসলিম আধা-সামরিক বাহিনী ইরানের কাছ থেকে সহায়তা পেয়ে আসছে, কিন্তু তারা আনুষ্ঠানিকভাবে ইরাকি সিকি'উরিটি ফো'র্সের সদস্য এবং আইএসের বি'রু'দ্ধে ল'ড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এই ঘাঁ'টিতে তিনি ইরাকি সেনাবাহিনীর জেনারেলদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, যারা আইএসের বি'রু'দ্ধে ল'ড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদার।

ইরাকি অংশীদারদের ঘা'টিতে যেতে হলে যে করিডোর দিয়ে প্রতিদিন যেতে হয় জোট বাহিনীর কর্মকর্তাদের, সেখানে অন্যান্য ইরাকি কমা'ন্ডারদের পাশাপাশি এখনো মুহানদিসের ছবিও ঝোলানো আছে। ইউনিয়ন থ্রি ঘা'টির দুইজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমাকে বলেছেন যে, তারা শুধুমাত্র সকালে ফোন ঘাটতে গিয়ে ওই হা'মলার খবর জানতে পারেন।

নাম না প্রকাশ করার শর্তে একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানালেন, ''যদি এমন কোন অভিযান চলে, যে বিষয়ে আপনার জানার প্রয়োজন নেই, তাহলে আপনাকে তা জানানো হয় না। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে যদি আপনাকে পড়তে হয়, তা হলেও না।''

এমনকি বাগদাদের মার্কিন ঘাঁ'টিতে যে ড্রোন অপা'রেটররা ছিলেন, তারাও প্রথমে মনে করেছিলেন, বিমানবন্দরের কাছাকাছি কূটনৈ'তিক আবাসিক এলাকায় হয়তো রকেট হা'মলা হয়েছে। কারণ ওই এলাকা ল'ক্ষ্য করে আগেও রকেট হা'মলা চালানো হয়েছে। কিন্তু বি'স্ফো'রণের পরে তারা যখন আ'গুন দেখতে পান, তখন বুঝতে পারেন যে, এটা ছিল ড্রোন হা'মলা। কিন্তু তারাও বুঝতে পারছিলেন না, কে হা'ম'লাটি চালিয়েছে।

এই ড্রো'ন হা'মলার ঘটনার কয়েকদিন আগে, মার্কিন ঘা'টিতে রকেট হা'মলার জবাব দেয়ার জন্য ইরাক-সিরিয়া সীমান্তের উভয় পাশে কাতিব হেজবুল্লাহ মিলিশিয়ার সদর দপ্তরে বিমান হা'মলা চালায় যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী, যাতে ওই শিয়া আধা-সামরিক বাহিনীর ২৫জন সদস্য নিহ'ত হয়।

তাদের শে'ষকৃ'ত্য অনুষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের বি'রু'দ্ধে বড় ধরণের বিক্ষো'ভে রূপান্তরিত হয় এবং বাগদাদের মার্কিন দূতাবাসে হা'মলা করেন শো'কবিহ'বল জনতা। কিন্তু শিয়া মিলিশিয়ারা মনে করে, ড্রো'ন হা'ম'লার মাধ্যমে সকল সীমা অতি'ক্রম করে ফেলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওই পদক্ষেপের সঙ্গে 'আইএসকে পরা'জিত' করার কোন সম্পর্ক নেই। 

ফলে তাতে ক্ষু'ব্ধ ইরানপ'ন্থী আধা-সামরিক বাহিনী এবং রাজনৈতিকরা দাবি করেন যেন, অতিস'ত্বর ইরাক ছেড়ে মার্কিন বাহিনী চলে যায়। কিন্তু জোট বাহিনী আশা করছে যে, তারা ইরাকি সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে খুব তাড়া'তাড়ি আইএসের বি'রু'দ্ধে চূড়ান্ত দফার অ'ভিযা'ন শুরু করতে পারবে। কিন্তু এ বিষয়ে অনি'শ্চয়তায় উভয় পক্ষের কমা'ন্ডারদের গণমাধ্যমের সাথে কথা বলতে অ'না'গ্রহী করে তুলেছে। 

বিশেষ করে যখন পরের দিনই রাজনৈতিকরা তাদের বিরো'ধিতা করতে পারে। আইএসের বি'রু'দ্ধে ল'ড়াইয়ে বেশ কয়েকবার ইরাকে এবং ইরাকি কমা'ন্ডারদের সঙ্গে ঘনি'ষ্ঠভাবে কাজ করা একজন জ্যেষ্ঠ জোট কর্মকর্তা বলছেন, ''আমাদের টিম সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চায়, এবং মিশন শেষ করতে চায়। আমরা ইরাকি জনগণকে বিশ্বাস করি এবং এবং ইরাকি নিরা'পত্তা বাহিনীগুলোকেও বিশ্বাস করি।'' 

তার ইরাকি সহযোগীদের সঙ্গে প্রতিদিন দেখা হয়, তারা একত্রে চা পান করতেন, কিন্তু ওই হা'মলার পর থেকে সম্পর্ক যেন অনেকটাই আনুষ্ঠানিক হয়ে উঠেছে। ইরাকি নিরা'পত্তা বাহিনীগুলো মনে করে তারা ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংক'টের ফাঁ'দে পড়ে গেছে।

ইরাকি জয়েন্ট অপারেশন কমান্ডের মুখপাত্র মেজর জেনারেল তাহসিন আল-খাফাজি বলছেন, ''এটা আমাদের সম'স্যা নয়। এমনকি এটা সামরিক কোন সম'স্যাও নয়। ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম'স্যা আছে আর তারা আমাদেরকে মাঝখানে ফেলে দিয়েছে। এই দুই দেশের জন্যই আমার বার্তা হল: আপনাদের সম'স্যা এখানে নিয়ে এসো না।'' ইরাকি সামরিক বাহিনী বলছে যে, জেনারেল সোলেইমানি হ'ত্যার পর জোট সহায়তা না পাওয়ায়, আইএসের বি'রু'দ্ধে তাদের একাই ল'ড়াই করা ছাড়া বিক'ল্প নেই। 

জেনারেল খাফাজি বলছেন, ''প্রথমবারের মতো আমরা আমাদের এফ-১৬ ফাইটার জেটগুলোকে উড়িয়েছি, আইএসের বি'রু'দ্ধে বিমান হা'মলা চালানোর জন্য। এটা ঠিক যে, আমরা একা ল'ড়াই করতে পারবো, কিন্তু আমরা এখনো জোট বাহিনীর সঙ্গে মিলে কাজ করতে চাই, যদি রাজনৈতিক কোন সম'স্যা না থাকে।'' এই মু'হূর্তে সবকিছুই একটা ভার'সাম্যের ওপর দুলছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী এতদিন যে হু'মকি মো'কাবে'লা করতো, তা আইএসে থেকে সরে একেবারে ভিন্ন কিছু হয়ে গেছে।

সেটা বেরিয়ে এলো মার্কিন এয়ারম্যান আলেজানড্রো পেনার বক্তব্যে, মাত্র দুইমাস আগে ইরাকে এসেছেন। যখন আমাদের এখানে মোতায়েন করা হয়, আমি ভেবেছিলাম আমি আইএসের বি'রু'দ্ধে যু'দ্ধ করতে এসেছি। কিন্তু কয়েকমাস পরে এখানে দেখতে পাচ্ছি, ''আরে না, এখানে অন্য প্রতিপক্ষও রয়েছে।'' সূত্র : বিবিসি বাংলা

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে