বুধবার, ২৫ মার্চ, ২০২০, ০৬:৪২:৪৭

''চারিদিকে শ্মশানের নিস্ত'ব্ধতা'' করোনা পরি'স্থিতি নিয়ে ইতালি থেকে বাঙালী তরুণী

''চারিদিকে শ্মশানের নিস্ত'ব্ধতা'' করোনা পরি'স্থিতি নিয়ে ইতালি থেকে বাঙালী তরুণী

স্বাতী চৌধুরি, মিলান থেকে: জর্জকে বিয়ে করে যখন পাকাপাকিভাবে ইতালি চলে এলাম, তখন কি ভেবেছিলাম, দেশজুড়ে এই মৃ'ত্যু মিছিল একদিন প্রত্য'ক্ষ করতে হবে? প্রতিটি সকাল শুরু হয় আত'ঙ্কের মধ্য দিয়ে। চোখ খুলেই ভাবি, না জানি আজ আবার কী দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে!

আপনারা যেমন 'রাজ্য' বলেন, ইতালিতে বলা হয় 'প্রভিন্স'। বিভিন্ন প্রভিন্সে আমাদের কত বন্ধু ও আত্মীয় যে কী অসহা'য়তা ও আত'ঙ্কের মধ্যে দিনযাপন করছে, বোঝাতে পারব না। হ্যান্ডশেক-দূরত্ব থেকে মৃত্যুকে এভাবে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা কতটা ভ'য়ং'কর হতে পারে, তা শুধু প্রত্য'ক্ষদ'র্শীরাই বলতে পারবেন। অথচ এই ম'র্মা'ন্তিক বে'দনা অনুভব করার মতো পরি'স্থিতিই ছিল না আমাদের।

মিলানের সেন্ট্রালে বাড়ি আমার। এখান থেকে গাড়িতে ঘণ্টা দুই গেলেই সুইজারল্যান্ডের সীমান্ত। জর্জকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে কতবার চলে গিয়েছে সেখানে। কিন্তু এখন সেসবই স্বপ্নের মতো লাগে। জানি না, ফের কবে সবকিছু আগের মতো স্বাভাবিক হবে। মিলান হচ্ছে ফ্যাশনদুর'স্ত মানুষদের পীঠস্থান। ইটালির মূল বাণিজ্যকেন্দ্রও বলা যায়। 

সারা পৃথিবীর শৌখিন ও ফ্যাশন-প্রিয় মানুষের ভিড়ে বছরের সারাটা সময় গমগম করে মিলানের রাস্তাঘাট। আর এখন চারিদিকে শ্ম'শানের নিস্ত'ব্ধতা। বসন্ত হলেও এখনও ঠা'ন্ডাটা যায়নি। তাপমাত্রা ঘোরাফেরা করছে এই ১০ ডিগ্রির আশপাশে। জ্যাকেট পরে ঘরের মধ্যে বসে আছি। আইসোলেশনে আছি বলাই ভাল। করোনা বালিগঞ্জের মেয়ে আমি। 

বিবাহসূত্রেই দীর্ঘদিন মিলানে আছি। অবরে-সবরে কলকাতা যাই। কিন্তু এখন, অষ্টপ্রহর, মন পড়ে আছে সেই কলকাতায়। বালিগঞ্জের বাড়িতে থাকা তিনজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে সামলাতে হচ্ছে মিলানের এই আইসোলেশনের ঘেরাটোপে থেকেই। তবে ওদের আমি সামলাব কী, বালিগঞ্জের বাড়িতে থাকা আমার বৃদ্ধ কাকুর মতো অন্য গুরুজনও বেশি চিন্তিত আমার জন্য। আপনারা নিশ্চয় প্রতিদিন খবর পাচ্ছেন- করোনা ভাইরাসের প্রকোপে ইটালির ভয়ংকর পরিস্থিতির কথা। সবাই চি'ন্তিত ইটালির কথা ভেবে। 

আমার যদিও মনে হয়, শুরুর দিকে ইটালির মতো সারা বিশ্বও যদি করোনা নিয়ে সামান্য সত'র্ক থাকত, তাহলে এই মৃ'ত্যুমিছিল এড়ানো যেত। চীনে যখন প্রথম করোনা ভাইরাসের প্রভাব চোখে পড়ে, তখন ডিসেম্বরের শেষ। সত্যি করে বলুন তো, তখন ভারতেও কি এ নিয়ে কোনও সত'র্কতা ছিল? করোনা নিয়ে বিশ্বের টনক নড়ল জানুয়ারির শেষের দিকে, যখন চীন প্রথম সরকারিভাবে ঘোষণা করল। 

ততদিনে চিনের সঙ্গে ব্যবসা-সহ নানা সূত্রে এই মহামা'রি ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। আমাদের ইটালিও যার বাইরে নয়। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে 'প্রভিন্স' লম্বার্ডির উত্তরে প্রথম এক ব্যক্তির করোনা ভাইরাস নিয়ে পজিটিভ রিপোর্ট পাওয়া যায়। তিনি কিন্তু বৃদ্ধ ছিলেন না। ৩০-৩৫ বছর মতো বয়স হবে। সেই শুরু। পরের দিনই জানা গেল, ভেনেতো প্রভিন্সে আরও কয়েকজনের 'পজিটিভ' ফল এসেছে। 

ভেনিস হচ্ছে ভেনেতো প্রভিন্সের রাজধানী। এরপর ধীরে ধীরে ইতালির বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খবর আসতে শুরু করে দেয়, যা এখন মহামা'রির আকার ধারণ করেছে। এর একটাই কারণ, আমরা কেউই শুরুতে এই মহামা'রি মো'কাবিলা করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এই মুহূর্তে সারা দেশে মৃ'ত্যুর সংখ্যা কত, এমনকী আ'ক্রা'ন্ত ব্যক্তির সংখ্যা কত, তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় রোজ নানারকম গু'জব ছড়াচ্ছে ইটালিতে। 

তবে আমরা গু'জবের থেকেও বেশি চিন্তিত কীভাবে মিলিতভাবে সম'স্যা প্রতিরো'ধ করব, তা নিয়ে। শেষ ১৫ দিন ধরে, সারা দেশে 'লকডাউন' জারি হয়েছে। রাস্তায় মিলিটারি, পুলিশ টহল দিচ্ছে। কিছুদিন আগেও এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান ছেড়েছে। কিন্তু এখন সব বন্ধ। নিয়ম হয়েছে, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য একদম সামনের সুপার মার্কেটে যেতে হবে। ধরুন, আপনার বাড়ি যাদবপুর। আর আপনি জিনিস কিনতে গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেলেন নিউ মার্কেট- এরকম করার সুযোগই নেই। 

তাই গাড়ি চলাচল পুরো বন্ধ। ট্রেন আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এরপরেও রাস্তায় বেরলে পড়তে হবে কড়া পুলিশি জেরার সামনে। যদি আপনি প্রমাণ করতে না পারেন, সত্যিই নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস অথবা ওষুধ কিনতে বেরিয়েছেন, তাহলে ভারি বি'পদ! সঙ্গে সঙ্গে কম করে ১৩৫ ইউরো জরি'মানা। তাই দরকার ছাড়া কেউই বাড়ির বাইরে পা রাখছেন না। অফিসের কাজ চলছে সব বাড়ি থেকে। 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম'। সংবাদমাধ্যম খোলা। 

তবে চেষ্টা চলছে, যতটা সম্ভব বাড়ি থেকে কাজ করার জন্য। যাদের অফিস যেতেই হবে, অফিসে একজনের সঙ্গে অন্যজনের দূরত্ব কম করে ৩ মিটার। আমি 'বিজনেস ইংলিশ' পড়াই। শেষ ১৫ দিন বাড়িতে বসে অনলাইনেই পড়াচ্ছি। বাড়ি থেকে না বেরলে কী হবে, ইটালিতে সবাই নিজেদের মধ্যে অনলাইনে যোগাযোগ রাখছে। অনলাইনে যদি অন্যদের কোনওভাবে সাহায্য করা যায়! সবাই তা-ই করছেন। আমি যেমন এখন অনলাইনে যোগা শেখাচ্ছি।

আরও একটা কথা বলার। সুপার মার্কেটে এখনও কিন্তু কোনও জিনিসের টান পড়েনি। এই ব্যাপারটায় সরকার অত্যন্ত কঠো'রভাবে পদক্ষেপ করছে। সরকারের নির্দেশে, বাড়িতে থাকার সময় বারবার করে ৩০ সেকেন্ড ধরে ভালভাবে হাত ধুচ্ছি কোহল-সমৃদ্ধ সাবান দিয়ে। বাইরে বেরলে, স্যানিটাইজার আর মাস্ক বাধ্যতামূলক। এককথায়, ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলছি আমরা। চারিদিকে চ'রম আত'ঙ্কের পরিবেশ। 

খালি মনে হচ্ছে, করোনা ভাইরাস নিয়ে সারা বিশ্ব কেন আরও একটু আগে সত'র্ক হল না! এর কোনও ওষুধ নেই। ফলে পুরো ইটালিতে চেষ্টা চলছে কোয়ারেন্টাইনের মাধ্যমে যতটা সম্ভব পরি'স্থিতি নিয়'ন্ত্রণে রাখার। এছাড়া, এই মুহূর্তে আর কীই-বা করতে পারি আমরা! আপনারাও, প্লিজ, বাড়ি থেকে বেরবেন না। প্রকৃতির কাছে আমরা সত্যিই বড় অস'হায়। সূত্র : সংবাদ প্রতিদিন 

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে