মঙ্গলবার, ০৭ এপ্রিল, ২০২০, ১২:২৩:১১

যেভাবে করোনা যু'দ্ধে হারছে ব্রিটেন

যেভাবে করোনা যু'দ্ধে হারছে ব্রিটেন

সুপ্রিয় চৌধুরী : কলকাতা লন্ডন হতে চায় না আর। বিলেত-ফেরত রোগীর ধা'ক্কায় ঔপনিবেশিক হা'ড়ম'জ্জায় হঠাৎ ভাইরাস ধ'রেছে। সময়ের নিরাপদ দূরত্ব থেকে ভবিষ্যতের ইতিহাসবিদরা আমাদের এই ক্র'মশ-প্রকাশ্য বিপ'র্যয়কে এক ঘুমে-হাঁটার উপাখ্যান হিসেবে দেখবেন। 

বন্যজন্তু খাওয়ার নিতান্ত চৈনিক অভ্যাস বাদুড়-রোগকে মানুষ-দেহে আনার পরেও চীন সরকার কয়েক মাস প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল ব্যাপারটা চাপা দিতে। কিন্তু তার পরেও, যখন এই অত্য'ন্ত সং'ক্রামক ব্যা'ধিটি অনেক দেশে ছড়িয়ে গিয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কয়েক দিন অপেক্ষা করল এই রোগকে মহামা'রি বলে ঘোষণা করতে। এবং তার পরেও, ব্রিটেন, সুইৎজ়ারল্যান্ড ও আমেরিকার মতো দেশ এই সং'ক্র'মণ রু'খতে এক খোলা-বাজারি নীতি নিল। 

ঠিক যেমন প্রথম বিশ্বযু'দ্ধে, বা ১৯২৯-এর মহাম'ন্দায়, বা ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক স'ঙ্কটে একটু একটু করে, এক জন এক জন করে, বিশ্ব বিপ'র্যয় তৈরি হয়েছিল, এ যেন তার পুনরাবৃ'ত্তি। ব্রিটিশ সংবাদপত্রকে বিশ্বাস করলে, ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে ভাইরাস মো'কাবিলা নীতির প্রথম আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা ডমিনিক কামিংস-এর বক্তব্য ছিল, কিছু বুড়ো লোককে মরতে দিলে বিশেষ কিছু ক্ষতি নেই (১০ ডাউনিং স্ট্রিট অবশ্য এটা অস্বীকার করেছে)। 

এক দশকের বিনিয়োগহীন দেউলিয়া ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের ভার লা'ঘব করার জন্যে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় সব অসুস্থ লোককে পরীক্ষা না করার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার 'পরীক্ষা-পরীক্ষা-পরীক্ষা' উপদেশ সত্ত্বেও ব্রিটেনে অসুস্থ হলে চোদ্দো দিন ঘরব'ন্দি থাকতে বলা হয়, পরীক্ষা ছাড়াই। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন তার প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়ে দেন, অনেককেই তাদের প্রিয়জনকে হা'রাতে হবে এই রোগের কাছে।

এই সময়ে ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, কোনও কারফিউ জারি করা হবে না। বরং, সরকারি নীতি ছিল 'হার্ড ইমিউনিটি' বা 'গোষ্ঠী প্রতিরো'ধক্ষ'মতা' তৈরি করা, যাতে অনেক লোকের মধ্যে মৃদু সং'ক্র'মণ ছড়িয়ে শরীরের প্রতিরো'ধক্ষ'মতা গড়ে তোলা যায়। এ এক অত্যন্ত ব্রিটিশ মানসিকতা— বৃষ্টির মধ্যে ফুটবল খেলে রোগ-প্রতিরো'ধের চেষ্টা! 

এই নতুন করোনা ভাইরাসের সামনে, যখন ইতালিতে হাজার হাজার লোক আক্রা'ন্ত এবং সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভা'ঙনের মুখে, সরকারি ব্রিটিশ নীতি ছিল শিশুদের চিকেন পক্স পার্টির মতো: সং'ক্র'মণ ছড়াবে তো ছড়াক। তাই, বিশ্বজোড়া মহামা'রির মধ্যে ব্রিটেনের স্কুল ২০ মার্চ পর্যন্ত খোলা ছিল, যদিও ছেলেমেয়েরা তার অনেক আগেই স্কুলে যাওয়া ব'ন্ধ করে দেয়।

এই রাস্তায় চলার সম'স্যা হল, করোনা ভাইরাস সাধারণ ফ্লু-র চেয়ে অনেক বেশি বিপ'জ্জনক— প্রায় চার গুণ লোক এতে মা'রা যায়। শরীরের প্রতিরো'ধ ক্ষমতা কী ভাবে এর মো'কাবিলা করবে, আমাদের জানা নেই। এও জানি না যে এক বার এই সং'ক্রমণ হলে সেটা আবার ফিরে আসতে পারে কি না। কিন্তু অফিস-কাছারি, শেয়ার বাজার না ব'ন্ধ করে ভাই'রাসের এই খোলা-বাজারি মো'কাবিলা করাটা সরকারের কাছে বড় আকর্ষণীয় লেগেছিল। 

ব্রেক্সিটের মতোই আর একটা অজানায় খোলা-বাজারের দোহাই দিয়ে চোখ বুজে ঝাঁপ দেওয়ার প্রলো'ভন সামলাতে পারেনি তারা। এই হিসাবটা একটা বড় ধা'ক্কা খায়। ইম্পিরিয়াল কলেজের মডেল দেখায় যে ওই রাস্তায় চললে ব্রিটেনে পাঁচ লক্ষ লোক মারা যাবে। এক বার সং'ক্রমণ ছড়াতে দিলে আর কিছুই করার থাকবে না, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে এবং অর্থনৈতিক দু'র্গ'তি অসীম হবে।

এর পর থেকেই সরকারের সুর-ব'দল শুরু, যদিও ততক্ষণে সং'ক্রমণ দ্রুত ছড়াতে শুরু করেছে। গত সপ্তাহে রাশ টেনে সব কিছু বন্ধ করা সত্ত্বেও সং'ক্রমণ এবং মৃ'তের সংখ্যা ক্র'মশ বেড়ে চলেছে। অপ্রস্তুতির পরিণামে যথেষ্ট পরীক্ষাও করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রাথমিক রাশছাড়া নীতির কারণে ব্রিটেনের যুবরাজ চার্লস, প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকক এবং ডমিনিক কামিংস করোনা ভাইরাসে আ'ক্রা'ন্ত হয়ে পড়েছেন। 

বিশাল আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করা সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকার এখনও স্থির করে উঠতে পারেনি যে ছোট ব্যবসাগুলোকে কী ভাবে সাহায্য করা যায়— তার ফলে প্রায় ৮০,০০০ ব্যবসা ব'ন্ধ হবার পথে। আর, ব্রিটেনের ভাইরাসের দূত দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এই বিপ'র্যয়ে নতুন যদি কিছু শেখার থাকে তবে তা হল— পুরনো ভাবনায় নতুন সম'স্যার সমাধান করা যায় না।

ব্রিটেনে একটা প্রবাদ প্রসিদ্ধ, ''ওয়াটারলুর যু'দ্ধ আসলে ইটন স্কুলের খেলার মাঠে জেতা হয়ে গিয়েছিল।'' অর্থাৎ ইটন স্কুলের শিক্ষা থেকে এমন সৈন্য তৈরি হয়েছিল যারা সহজেই যু'দ্ধ জিততে পারে। তবে এই প্রবাদের আরও একটা অংশ আছে, যা অতটা জানা নয়: ''কিন্তু পরের সব যুদ্ধের প্রথম লড়াইটা সেখানেই হারা হয়েছে'। অর্থাৎ পুরনো প্রথাগত ভাবনা দিয়ে এর পর আর লড়াই-এর মাঠে সুবিধা হয়নি। 

বলা যেতে পারে, করোনা ভাই'রাসের বিরু'দ্ধে যু'দ্ধের প্রথম রাউন্ডও ইটন মাঠে হে'রেছে ব্রিটেন। এ বার দেখার, হা'রকে জিত বানানোর ব্রিটিশ অভ্যেস বজায় থাকবে কি না। কিন্তু ব্রিটেনে যাই হোক, অন্যদের এই ভু'লগুলোর মা'শুল দিতেই হবে, যেমন গত তিনশো বছর ধ'রে হয়েছে।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে