শুক্রবার, ০৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯, ১১:৫৯:২৩

ভাতের টাকা নেই, এমনই দুরবস্থা লোকশিল্পী কাঙ্গালিনী সুফিয়ার!

 ভাতের টাকা নেই, এমনই দুরবস্থা লোকশিল্পী কাঙ্গালিনী সুফিয়ার!

বিনোদন ডেস্ক: চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে নয় ধরনের ট্যাবলেট। কোনোটা খাওয়ার আগে খেতে হয়, কোনোটা পরে। আছে সিরাপও। ওষুধ কিনতেই সব টাকা ফুঁ। ভাত খাওয়ার টাকা কোথায় পাবেন তিনি?

এমনই দুরবস্থা লোকশিল্পী কাঙ্গালিনী সুফিয়ার। পরানের বন্ধুদের কেউ এখন পাশে নেই। টেলিভিশন, রেকর্ড কোম্পানি কিংবা যাঁরা গান করতে ডাকতেন, কেউ খোঁজ নেন না। সম্বল কেবল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া ১০ হাজার টাকা। দুস্থ শিল্পী হিসেবে ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি পেতেন ৫ হাজার টাকা। ২০১৪ সাল থেকে সে অঙ্ক দ্বিগুণ হয়ে প্রতি মাসে দাঁড়ায় ১০ হাজার টাকায়। এই টাকার সঙ্গে গান গেয়ে পাওয়া টাকায় বড় মেয়ে পুষ্প বেগম ও তিন নাতিকে নিয়ে কোনো রকম চলে যেত শিল্পীর। কিন্তু অসুস্থ হওয়ার পর থেকে গান করা বন্ধ। বন্ধ আয়ের পথও।

হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে
গত ডিসেম্বরে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন কাঙ্গালিনী সুফিয়া। তড়িঘড়ি করে নেওয়া হয় সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রাখা হয় করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ)। চিকিৎসা ও নানা রকম পরীক্ষা করতে একগাদা টাকা খরচ হয়ে যায়। কাঙ্গালিনী সুফিয়া রোগী হয়ে এসেছেন শুনে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন মেডিকেল কলেজের চেয়ারম্যান দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ড. মো. এনামুর রহমান।

সুফিয়ার মেয়ে পুষ্প বেগম জানান, তাঁর কল্যাণে শেষের দিকে কিছু ওষুধ বিনা মূল্যে পান তাঁরা। কিন্তু একদিন দুপুরে গিয়ে জানতে পারেন, সেখানে আর রাখা সম্ভব হচ্ছে না তাঁকে। ওই হাসপাতাল থেকে আট দিন পর চিকিৎসকেরা তাঁকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজে নেওয়ার পরামর্শ দেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে কাঙ্গালিনী সুফিয়াকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় ১১ ডিসেম্বর। রাখা হয় ২০৬ নম্বর কেবিনে। মাকে কেবিনে নেওয়ার পর দিশেহারা হয়ে পড়েন পুষ্প। ভর্তির পর রোগীকে ওষুধ দিতে হবে। হাতে টাকা-পয়সা ছিল না। আট দিনে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খরচ হয়ে গেছে লাখ খানিকের বেশি টাকা। পুষ্প বলেন, ‘নার্সরা দ্রুত ওষুধ আনতে তাগাদা দেয়। আমি তখনো জানি না, কে বা কারা মাকে এই হাসপাতালে নিয়ে এল। আবার সেখানে রেখে হাওয়া হয়ে গেল। নার্সেরা আমাকে পাঠাল এক ডাক্তারের কাছে। সেখানে গিয়ে বললাম, আমার মা কাঙ্গালিনী সুফিয়া আপনাদের এখানে ভর্তি হয়েছে। তিনি বললেন, এখনকার মতো ওষুধ দিচ্ছি। কিন্তু পরের ওষুধগুলো কিনে আনতে হবে। পরে জানতে পারলাম, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কাগজ তখনো তাঁদের হাতে পৌঁছেনি। সে জন্যেই এই অবহেলা।’

হাসপাতালে গিয়ে এ যাত্রায় আবারও বেঁচে গেছেন কাঙ্গালিনী সুফিয়া। কিন্তু সেখানকার অভিজ্ঞতা খুব একটা ভালো ছিল না তাঁর। হাসপাতাল থেকে সরবরাহ করা খাবার বয়সী সুফিয়ার পক্ষে খাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। মায়ের জন্য বাইরে থেকে খাবার এনে খাওয়াতে শুরু করেন পুষ্প। তিনি বলেন, ‘একদিন দেখলাম, টাকায় আর কুলাচ্ছে না। তারপর বাড়ি থেকে চাল নিয়ে রান্না করে খাওয়াতে শুরু করলাম। একদিন ডাক্তার কামরুল হাসান তরফদার মায়ের জন্য দুই হাজার টাকা দিয়ে যান। সেই টাকা আমার বড় উপকারে আসছিল।’

পুষ্প বলেন, ‘একদিন মায়ের টেস্ট রিপোর্ট চেয়ে পাঠালেন ডাক্তারেরা। কিন্তু তখনো রিপোর্ট আমাদের হাতে আসেনি। একবার দোতলা, একবার সাত তলা, আবার দোতলা করতে করতে বিরক্ত হয়ে নার্সকে বললাম, আমার পক্ষে সম্ভব না। আপনারা রিপোর্ট আনার ব্যবস্থা করেন। নার্স খুব খারাপ ব্যবহার করল। বলল, এটা আমাদের কাজ না।’

পুষ্প জানান, ওষুধ ও প্রয়োজনীয় পরীক্ষার আর্থিক সাহায্য চেয়ে একপর্যায়ে তাঁদের রোগী কল্যাণ সমিতিতে আবেদন করার পরামর্শ দেওয়া হয়। সেই আবেদনপত্র নিয়ে অথই সাগরে হাবুডুবু খাওয়ার দশা হয় তাঁদের। এর মধ্যে চার দিন কোনো ওষুধ দেওয়া হয়নি সুফিয়াকে। তারপর গত ৬ জানুয়ারি হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে সাভারের জামসিংয়ে নিজের বাড়িতে ফিরেছেন সুফিয়া।

সুফিয়া বাঁচতে চান
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে এই প্রতিবেদক গিয়ে হাজির হন সুফিয়াদের সাভারের বাড়িতে। এক মেয়ে, তিন নাতনি ও ছোট্ট কুকুরছানা লালুকে নিয়ে সুফিয়ার সংসার। বাড়ির প্রবেশপথ একটাই সরু যে, একটু স্বাস্থ্যবান মানুষের পক্ষে ওই পথ দিয়ে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। এ নিয়ে আক্ষেপ করে পুষ্প বেগম বলছিলেন, ‘বাড়ির কেউ মারা গেলে লাশ বের করার উপায় নেই। জায়গার মালিক এতটুকু জায়গাও ছাড়েনি।’

দুপুরের রোদে প্লাস্টিকের টুল পেতে বসেছিলেন শিল্পী কাঙ্গালিনী সুফিয়া। কেমন আছেন—জানতে চাইলে বলেন, ‘বুকের মধ্যে ধকধক করে। মাথার ভেতরে ঘোরে। মনে হয় এই বুঝি পড়ে যাব। আমার বাঁচতে ইচ্ছা করে। কেউ কি তাড়াতাড়ি মরতে চায়?’

ডাক্তার কী বলেছে? জানতে চাইলে বাজারের ব্যাগ ভরা একগাদা টেস্ট রিপোর্ট, পরামর্শপত্র নিয়ে আসে সুফিয়ার নাতনি চুমকি আক্তার। সেগুলো নেড়েচেড়ে দেখা যায়, বয়সজনিত চার পাঁচটি সমস্যার সঙ্গে হাইপারটেনশনও আছে তাঁর। পুষ্প বলেন, ‘মা গান বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে পরিবারের আয়-রোজগার বন্ধ। টাকা ধার করতে করতে অনেক টাকা ঋণ হয়ে গেছে। পাওনাদারেরা এসে টাকা চায়, সেই চিন্তায় মা স্ট্রোক করসে। মেয়ে দুটোকে লেখাপড়া করাতে পারতিসি না। দুজনই এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। ৯ তারিখে তাদের পরীক্ষা। পাস করার পর ভর্তি করব কীভাবে?’

সুফিয়াকে বাঁচানো যাবে
কী হবে সুফিয়ার? কীভাবে চলবে তাঁর সংসার? তিনি গানের মানুষ। তবে এখন আর গাইতে পারেন না। কিন্তু বাঁচতে চান তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি তাঁর জন্য দোয়া করছি। তিনি যেন আবারও ইলেকশনে জিতে যান। তাঁর দেওয়া টাকায় আমি এখনো বেঁচে আছি। এখন আমার একটা নাতনিকে একটা সরকারি চাকরি দিলে আমার পরিবারটা বাঁচে। তাঁর কাছে যাইতে পারলে এই অনুরোধটা আমি তাঁরে করতাম।’

ফেরার সময় এই প্রতিবেদকের পিঠে মমতার হাত বুলিয়ে সুফিয়া বলেন, ‘আমার কোনো ছেলে-সন্তান নাই। তোমরাই পারো আমারে বাঁচাইতে।’ কাঙ্গালিনী সুফিয়ার শেষ অ্যালবাম ‘মা’। এটি তাঁর প্রথম ও বলা যায় শেষ সিডি। সুফিয়ার বাড়িতে এক কার্টুন সিডি আছে। শিল্পীকে সাহায্য করতে চাইলে ০১৭৭৯৭৫৯৪৪৮ নম্বরে নিজের ঠিকানা ও টাকা পাঠিয়ে সিডিগুলো সংগ্রহ করা যাবে। ‘মা’ অ্যালবামে আছে ১১টি গান। সুফিয়ার বাউলগান ছাড়াও তাতে আছে লালন সাঁই ও বিজয় সরকারের গান। ২০১৬ সালে ‘মা’ অ্যালবামটি প্রকাশ করেছিল যাত্রা।

কাঙ্গালিনী সুফিয়ার জন্ম ১৯৬১ সালে। প্রকৃত নাম টুনি হালদার। ‘কোনবা পথে নিতাইগঞ্জ যাই’, ‘বুড়ি হইলাম তোর কারণে’, ‘নারীর কাছে কেউ যায় না’, ‘আমার ভাঁটি গাঙের নাইয়া’সহ বেশ কিছু জনপ্রিয় গানের শিল্পী তিনি। গ্রামের অনুষ্ঠানে গান গেয়ে ১৪ বছর বয়সে মানুষের নজর কেড়েছিলেন তিনি। এক সময় বাংলাদেশ টেলিভিশনের নিয়মিত শিল্পী হিসেবে অন্তর্ভুক্তি পান। তাঁর গানের গুরু ছিলেন গৌর মহন্ত ও দেবেন খ্যাপা। হালিম বয়াতির কাছেও গান শিখেছিলেন তিনি। এ পর্যন্ত ৩০টি জাতীয় ও ১০টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন এই শিল্পী।-প্রথম আলো

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে