সোমবার, ০৮ জুলাই, ২০১৯, ১০:২০:৩২

প্রেমিকার ওপর হিংস্রতা : 'কবীর সিং' নিয়ে তুলকালাম!

প্রেমিকার ওপর হিংস্রতা : 'কবীর সিং' নিয়ে তুলকালাম!

বিনোদন ডেস্ক: ভালোবাসার মানুষের ওপর আপনার কতটুকু অধিকার থাকা উচিত? নিজের প্রেমিকাকে খুব বেশি ভালবাসলে তাকে কি যখন খুশি চড় মারা যায়? তার বিরুদ্ধে যে কোনো সময় হিংস্র হয়ে ওঠা চলে? এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর যা-ই হোক, ঠিক এই ধরনের দৃশ্যায়ন করেই ভারতে তুমুল বিতর্কের কেন্দ্রে চলে এসেছে একটি বলিউড মুভি - যার নাম 'কবীর সিং'। বাস্তব জীবনেও এই ধরনের আচরণকে সমর্থন করে ছবির পরিচালকের দেওয়া সাক্ষাৎকার সেই বিতর্কে আরও ইন্ধন জুগিয়েছে।

ভারতের বহু মহিলা সেলেব্রিটি যেমন কবীর সিং ও তার নির্মাতার কড়া সমালোচনা করছেন, পাশাপাশি ছবিটি কিন্তু বক্স অফিসেও কোটি কোটি রুপির ব্যবসা করছে। কিন্তু নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতাকে প্রকারান্তরে সমর্থন করেও ছবিটি কীভাবে ভারতে এতটা সাড়া পাচ্ছে? আসলে 'অর্জুন রেড্ডি' নামে দক্ষিণ ভারতের একটি সুপারহিট তেলুগু ছবির হিন্দি রিমেক হল কবীর সিং। মুক্তির সময় থেকেই এই ছবিটি ভারতে সামাজিক মতামতকে কার্যত দুই ভাগ করে দিয়েছে।

ছবিটির বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ, এটি 'মিসোজিনি' বা নারীর বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও সহিংসতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। নায়ক সেখানে ইচ্ছেমতো প্রেমিকার সঙ্গে জোর খাটান, মারধর করেন, এমন কী ছুরি দেখিয়ে কাউকে শয্যাসঙ্গিনী করতেও দ্বিধা করেন না। কবীর সিংয়ের ভূমিকায় অভিনয় করা শাহিদ কাপুর অবশ্য যুক্তি দিচ্ছেন, 'কলেজ জীবনেও তো আমরা এই জাতীয় ছেলে দেখেছি যারা নিজের এলাকা, নিজের গার্লফ্রেন্ডের ত্রিসীমানায় কাউকে ঘেঁষতে দিতে চায় না। আবার এমন ছেলেপিলেও থাকে যারা স্বভাবে মোটেও আগ্রাসী নয়। অভিনেতা হিসেবে আমাকে তো সব ধরনের চরিত্রই করতে হবে - তাই না?'

তবে ছবিটি নিয়ে বিতর্ক আরও উসকে দিয়েছেন পরিচালক সন্দীপ রেড্ডি ওয়াঙ্গা নিজেই। ফিল্ম ক্রিটিক অনুপমা চোপড়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'গভীরভাবে কাউকে ভালবাসলে, সেই ভালবাসায় সততা থাকলে পরস্পরকে তাদের চড় মারারও অধিকার থাকে, যেখানে খুশি স্পর্শ করার স্বাধীনতাও তৈরি হয়। যে নারীরা এটার নিন্দা করছেন আমি বলব তারা সত্যিকার প্রেমের স্বাদই পাননি।'

কলকাতার কথাসাহিত্যিক তিলোত্তমা মজুমদারের কিন্তু স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে কবীর সিংয়ের নির্মাতারা সমাজের একটা রূঢ় বাস্তবতার কথাই বলেছেন। তার মতে, 'পরিচালক নিজের অন্তরের বিশ্বাস থেকে কথাটা বলেছেন, না কি ছবির বিজনেস প্রোমোশনের উদ্দেশ্যে বলেছেন তা হয়তো বলা মুশকিল। তবে যে কথাটা তিনি বলেছেন - যে যেখানে-সেখানে, যখন খুশি ছোঁয়ার অধিকার না-থাকলে আর ভালবাসা কী - এই বিশ্বাস সমাজে অনেকেই আজও পোষণ করেন তা কিন্তু ঠিক!'

তিনি আরও বলেন, 'আমাদের সমাজে মনে করা হয়- 'আমি ভালবাসি মানে সে আমার।'  কিন্তু এই অধিকারবোধের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে যত্র-তত্র ছোঁয়ার মধ্যে দিয়ে যে একটা সীমানা অতিক্রম করা হচ্ছে এবং একজন মানুষ আর একজনের সঙ্গে তা কিছুতেই করতে পারে না - সেই শিক্ষাটাই আমাদের সমাজে এখনও পর্যন্ত নেই।'

তিলোত্তমা মজুমদারের মতে, 'সমাজে যা আছে তা বলতে অসুবিধা কোথায়? বোতলের ছিপি খুলে দৈত্যটা বের করাই বরং ভালো, ঢাকা-চাপা দেওয়ার সময় অনেক আগেই তো আমরা পেছনে ফেলে এসেছি!' কিন্তু ভারতের ব্যাডমিন্টন তারকা জালা গুট্টা বা দক্ষিণী নায়িকা সামান্থা রুথ প্রভু আবার পরিচালকের ওই বক্তব্যকে নির্যাতনের সাফাই দেওয়ার চেষ্টা হিসেবেই দেখছেন।

দক্ষিণ ভারতের জনপ্রিয় গায়িকা চিন্ময়ী শ্রীপদা আবার সোশ্যাল মিডিয়াতে বলেন, 'ভারতের আমজনতা কিন্তু সেলুলয়েড আর বাস্তব জীবনের ফারাক করতে জানে না। এদেশে এখনও সিনেমায় ধূমপানের দৃশ্য থাকলে লোককে মনে করিয়ে দিতে হয়, তামাক ক্যান্সার ডেকে আনে। ভারতে যেখানে এমনিতেই হিংসা বা নির্যাতন আখছার ঘটেছে, সেখানে অন্তত প্রেমের দোহাই দিয়ে সেটাকেই স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করা উচিত নয়।'

কেম্ব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের অধ্যাপক ও সমাজতাত্ত্বিক শমিতা সেন মনে করছেন, ভায়োলন্সের মাত্রাটা অতিরিক্ত হতে পারে - কিন্তু কবীর সিং বলিউডে কোনো ব্যতিক্রমী ধারার ছবি নয়। তার কথায়, 'বলিউডে সব ছবিই যদি ভালো হতো, আর এই কবীর সিং একলা একটা অন্যরকম হত, তাহলে আমি বলতাম যে এক-আধটা 'এক্সসেপশনাল পোর্ট্রেয়াল' মানতে রাজি আছি।'

উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, 'যেমন রোমান পোলানস্কির ছবিতে গভীর ও অন্তরঙ্গ রিলেশনশিপে তিনি বারবার এক্সট্রিম ভায়োলেন্স দেখিয়েছেন। কিন্তু সেটা তার ছবির এক বিশেষ ধারা, পোলানস্কি আর্ট বা শিল্পকে ওই ভাষাতেই নিয়ে গেছেন - সেটাকে আমি সমাজের চিত্রায়ন বলব না। কিন্তু ভারতের পটভূমিতে তো এই কবীর সিং সেই অর্থে কোনো ব্যতিক্রম নয়! বরং বলিউডে তো এটাই নর্মাল, এটাই স্বাভাবিক। সিনেমাকেই শুধু দায়ী করলে চলবে না। আমাদের সিনেমাও তো আমাদের সমাজ থেকেই রসদ নেয়।'

সমাজের সেই আলো-আঁধারি থেকে রসদ নিয়েই কবীর সিংও আড়াই সপ্তাহেরও কম সময়ে আড়াইশো কোটি রুপির ব্যবসা করেছে। ওদিকে ভালোবাসার অধিকারের সীমাটা ঠিক কতদূর সে প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজে মরছে ভারতের দর্শকদের একাংশ।বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে