বৃহস্পতিবার, ১৪ মার্চ, ২০১৯, ০২:৫২:০৭

একটু সচেতন হলে কিডনি সবল রাখা সম্ভব

একটু সচেতন হলে কিডনি সবল রাখা সম্ভব

ডা. মো. আশরাফুল হক: কিডনি আমাদের শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কিডনি অকেজো হয়ে পড়লে মৃত্যু বলা চলে নিশ্চিত। কিডনি নিয়ে একটু সচেতনতা তাই অত্যাবশ্যক। নানা কারণে আমাদের কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সঠিক সময়ে বুঝতে না পারার কারণে যখন রোগ ধরা পড়ে তখন বলতে গেলে বেশ দেরিই হয়ে যায়। সাধারণভাবে বলতে গেলে কিডনির যে স্বাভাবিক কাজ, তার অর্ধেক কমে গেলে শরীরে লক্ষণ অনুভব হয়।

কিডনি রোগ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনই হচ্ছে রোগ নিরাময়ের মূলশক্তি। রোগের লক্ষণগুলো সম্পর্কে ভালোভাবে ধারণা থাকলে সে অনুযায়ী নিরাময়ের ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হয়। কারণ কিডনি রোগের উপসর্গগুলোর সঙ্গে অন্য স্বাস্থ্য সমস্যার উপসর্গের মিল আছে।

কিডনি রোগের প্রাথমিক লক্ষণ—

১। রাত্রিকালীন প্রস্রাব হওয়া : যদিও এটি অনেকের ক্ষেত্রে অভ্যাসের অংশ, তবুও এটি যাদের ক্ষেত্রে নতুন দেখা যাচ্ছে তাদের সচেতন হওয়া বাঞ্ছনীয়।

২। দুর্বল লাগা :  কিডনির কর্মক্ষমতা যখন কমে যায় তখন রক্তে অপদ্রব্য হিসেবে দূষিত পদার্থ শরীর থেকে বের হতে পারে না। এর ফলে আপনি দুর্বল ও ক্লান্তি অনুভব করেন এবং কোনো বিষয়ে মনোযোগ দেওয়াটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়া কিডনি রোগীদের অ্যানিমিয়া হওয়াটাও অনেকটাই স্বাভাবিক ঘটনা। এসব কারণেও দুর্বলতা দেখা দেয়।

৩। শ্বাসকষ্ট হওয়া : মেটাবলিক এসিডুসিস সৃষ্টি হওয়ার কারণে বেশির ভাগ রোগীর শ্বাসকষ্ট দেখা যায়, কারো ক্ষেত্রে সেটি হয় স্বাভাবিক শ্বাসের চেয়ে বেশি আবার কারো ক্ষেত্রে বেশ বেশি।

৪। ত্বক শুষ্ক হয়ে ফেটে যাওয়া।

৫। চোখের চারপাশে ফুলে যাওয়া।

৬। পায়ের গোড়ালি ও পায়ের পাতা ফুলে যাওয়া। কিডনির কার্যকারিতা কমে গেলে সোডিয়ামের পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে পা ও গোড়ালি ফুলে যায়। পায়ের নিচের অংশ ফুলে যাওয়া, হার্ট, লিভার এবং পায়ের শিরার দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার লক্ষণও হতে পারে।

৭। ক্ষুধা কমে যাওয়া : এটি খুবই সাধারণ সমস্যা কিন্তু শরীরে টক্সিনের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে কিডনির কার্যকারিতা কমে যাওয়ার ফলস্বরূপ ক্ষুধা কমে যায়।

৮। শীত শীত অনুভব হওয়া : কিডনি রোগ হলে গরম আবহাওয়ার মধ্যেও শীত শীত অনুভব হয়। আর কিডনিতে সংক্রমণ হলে জ্বরও আসতে পারে।

৯। বমি হওয়া বা বমি বমি লাগা : রক্তে বর্জ্য পদার্থ বেড়ে যাওয়ায় কিডনির রোগে বমি বমি ভাব এবং বমি হওয়ার সমস্যা হতে পারে।

যদি উপরোক্ত উপসর্গগুলো দেখা যায়, তাহলে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করে সিম্পল ইউরিন টেস্ট  (ACR) এবং ব্লাড টেস্ট (GFR) করিয়ে আপনার কিডনির কোনো সমস্যা আছে কি না নিশ্চিত হওয়া জরুরি।

কিভাবে প্রতিরোধ সম্ভব

এই আটটি পদ্ধতি হলো—

১। মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ : মানসিক চাপ যেকোনো রোগের জন্যই ক্ষতিকর। দৈহিক চাপ বিশ্রামে পূরণ হয় কিন্তু মানসিক চাপ শুধু বিশ্রামে পূরণ হয় না। প্রার্থনা করা, মেডিটেশন, যোগব্যায়াম, বিনোদনমূলক স্থানে ঘুরতে যাওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে খুব সহজেই আমরা মানসিক চাপমুক্ত হতে পারি। 

২। কায়িক পরিশ্রম ও নিয়মিত ব্যায়াম করা : শারীরিক পরিশ্রম যত সম্ভব বেশি করা। শারীরিক পরিশ্রম করার উপকারিতা অনেক। তার অন্যতম হলো—রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকা, শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি পাওয়া, ক্ষতিকারক চর্বির (কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইড) মাত্রা কম থাকা, ভালো ঘুম হওয়া, ইনসুলিনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পাওয়া, শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকা ইত্যাদি।

৩। উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা : উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস কিডনি বিকলের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত। এ দুটি রোগ শুধু কিডনি বিকলই করে না; হৃদরোগ, ব্রেইন স্ট্রোক, অন্ধত্ববরণসহ অসংখ্য রোগের জন্ম দেয়। কাজেই এগুলোর হাত থেকে বাঁচতে হলে রক্তচাপ এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যেন তা ১৩০/৮০-এর নিচে থাকে। এবং ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, যাতে হিমোগ্লোবিন  HbA1C লেভেল ৭-এর নিচে থাকে।

৪। কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ।

৫। খাদ্য তালিকা থেকে চিনি বাদ দেওয়া।

৬। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, সুষম খাদ্য গ্রহণ (কিডনি এবং হার্টের জন্য উপযোগী খাদ্য), খাবারের মাঝে লবণের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে। তাজা সবজি ও ফল গ্রহণ এবং তৈরীকৃত খাদ্য থেকে বিরত থাকা খুবই জরুরি। সম্পৃক্ত চর্বির পরিমাণ যেসব খাবারে বেশি তা বেশি গ্রহণ না করাই নিরাপদ। যেমন—ডিম, দুধ, ভাজা খাবার ইত্যাদি। ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড যেগুলো বেশি গ্রহণ করা। যেমন—সামুদ্রিক মাছ বেশি গ্রহণ করা প্রয়োজন।

৮। ধূমপান থেকে বিরত থাকা : ধূমপানের ফলে কিডনি বিকল হয়, কিডনিতে ক্যান্সার হয়, কিডনি ও মূত্রনালিতে ক্যান্সার সৃষ্টি হয়।

৯। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ সেবন না করা : দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন ব্যথা-বেদনার ট্যাবলেট খাওয়ার ফলে কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যায়, ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কিডনি বিকল হয় ওষুধ খাওয়ার কারণে। এ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকসহ অনেক ওষুধ কিডনির মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।

১০। নিয়মিত কিডনির কার্যকারিতা পরীক্ষা করা : হৃদরোগের সঙ্গে কিডনির প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। হৃদরোগ কিডনির ঝুঁকি বৃদ্ধি করে আবার কিডনির সমস্যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। কারো যদি জানা থাকে তার কিডনি বা হৃদরোগ রয়েছে, তবে এগুলো নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত।

যাদের কিডনি রোগ ধরা পড়েছে তাদের সবাইকে যে ডায়ালিসিস নিতেই হয় তা একেবারে ভ্রান্ত ধারণা। সঠিক জীবনযাত্রা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং সঠিক ওষুধ সেবনে কিডনি রোগীরাও ভালো থাকতে পারেন এবং পারছেন। আমাদের দেশে একটি পরিচিত সমস্যা দেখা যায়, আর তা হলো একজন রোগী আরেকজনের পথ্য, জীবনযাত্রা, খাদ্যের তালিকা অনুসরণ করে থাকেন, যা মোটেও উচিত নয়।  একেকজনের ক্যালরির চাহিদা একেক রকম, ওষুধের তালিকা ভিন্ন রকম। হাতের পাঁচ আঙুল যেমন সমান না, তেমনি একজনের সঙ্গে আরেকজনের হুবহু মিল হওয়াটাও স্বাভাবিক নয়।

আমাদের দেশে সাম্প্রতিক সময়ে কিডনি রোগের চিকিৎসায়  Stem cell ব্যবহার হচ্ছে। দু-একটি প্রতিষ্ঠান এটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সাফল্যের ব্যাপারে প্রথম দিকে ব্যাপক আশার সঞ্চার করলেও সেই সাফল্য এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান নয় বড় পরিসরে। সারা পৃথিবীতে এটি নিয়ে কাজ চলছে কিভাবে একে আরো সফল করা যায়। তবে এখনো কেউ ১০০ শতাংশ সফলতা দাবি করতে পারেনি। কিডনি রোগীর শরীরে যে অবাঞ্ছিত উপাদান তৈরি হয় তা এই স্টেম সেলগুলোকে পরিপূর্ণ কাজ করতে দেয় না বা করার পরিবেশ তৈরিতে বাধা দেয়। তাই বাইরের দেশের গবেষকরা চিন্তা করছেন কিভাবে সুস্থ মানুষ থেকে

ঝঃবস ঈবষষ সংগ্রহ করে রোগীর শরীরে কাজে লাগানো যায়। আমরা এ ক্ষেত্রে এখনো অনেক পেছনে পড়ে রয়েছি। আমাদের দেশের সিনিয়র চিকিৎসকরা এ কারণে Stem cell ব্যবহারে সচেতন হওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। কিডনি রোগের সর্বশেষ চিকিৎসা হলো কিডনি প্রতিস্থাপন। এই স্তরে যাঁরা পৌঁছেছেন তাঁদের জন্য এর বিকল্প এখনো বের করা সম্ভব হয়নি। আমাদের দেশে বেশ সফলতার সঙ্গে কিডনি প্রতিস্থাপিত হচ্ছে বেশ কয়েকটি সেন্টারে। আগে রক্তের গ্রুপ না মিললে কিডনি দান করা যেত না, যা এখন সাফল্যের সঙ্গেই আমাদের দেশে মোকাবেলা করা হচ্ছে। 

লেখক : ট্রান্সফিউশন মেডিসিন স্পেশালিস্ট, সেন্টার ফর মেডিক্যাল বায়োটেকনোলজি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে