বর্তমান এই আধুনিকতায় Bluetooth শব্দটির সঙ্গে পরিচিন নন এই রকম লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আধুনিক এই যুগে আপনি যেই ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসই ছুতে যান না কেন, সেই ডিভাইসের সঙ্গে ওয়্যারলেস (তারবিহীন) নিয়ন্ত্রণ বা যোগাযোগের সুবিধা না থাকলে তা কেন যেন স্মার্ট মনে হয় না। আর এই তারবিহীন নিয়ন্ত্রণ বা যোগাযোগ সুবিধার অন্যতম মাধ্যমই হচ্ছে ব্লুটুথ প্রযুক্তি। যেমন মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ডেক্সটপ, হোম থিয়েটার, স্মার্ট ওয়াচ, হেডফোন আরও অনেক ডিভাইস আছে, যেগুলোতে ব্লুটুথ অপশন থাকা এখন বাধ্যতামূলকই হয়ে গেছে।
ব্লুটুথ হলো এক ধরনের ওয়ারলেস টেকনোলজি যার মাধ্যমে ১০ থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে কোনরকম ওয়্যার (তার) ছাড়া দুটো বা তার বেশি ডিভাইসের মধ্যে ডাটা ট্রান্সফার করা যায়। ১৯৯০ সালে নেদারল্যান্ডের বিখ্যাত কালেক্টরেট ইঞ্জিনিয়ার জাপ হার্টসেন ব্লুটুথ আবিষ্কার করেন। যে কারণে তাকে ব্লুটুথের জনকও বলা যেতে পারে। কিন্তু জনকের নামের সাথে এই প্রযুক্তির নামের কোনও মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু কেনো এই ব্লুটুথের নাম ব্লু-টুথ রাখা হলো? তাহলে কি নীল দাঁতের কোনো রহস্য আছে এর পেছনে!
জানলে চমকে যাবেন, ব্লুটুথ টেকনোলজির নামকরণ হয়েছিল দশম শতাব্দীর ডেনমার্কের এক ভাইকিং রাজা ‘হারাল্ড ব্লুটুথ’ এর নামে। এই রাজা সম্পর্কে দুটি প্রবাদ রয়েছে। এরমধ্যে একটি হচ্ছে, এই রাজার মুখের একটি দাঁত ছিল নষ্ট। নষ্ট এই দাঁতটি দেখতে ছিল নীল রঙের। সে জন্যই এই রাজা ‘হ্যারল্ড ব্লুটুথ’ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন।
এছাড়াও রাজার এই নামের পেছনে আরেকটি গল্প প্রচলিত আছে। সেটি হলো, রাজা হারাল্ডের প্রিয় ফল ছিল ব্লুবেরি। তিনি সবসময় এই ব্লুবেরি খেতে ভালোবাসতেন। ফলে রাজার দাঁতের রং নাকি নীল বর্ণের হয়ে গিয়েছিল। আর সেই জন্যই নাকি রাজাকে ব্লুটুথ নামে ডাকা হতো।
১৯৯৬ সালের দিকে একদিন ইন্টেলের এক প্রকৌশলী জিম কারদাক ও এরিকসনের এক প্রকৌশলী সেভেন ম্যাটিসন একটি প্রতিযোগিতায় হেরে যাবার পর, একসাথে একটি বারে মদ পান করতে যান। মদ পান করার ফাঁকে ফাঁকে তাদের মধ্যে ইতিহাস নিয়ে গল্প হতে থাকে। ম্যাটিসন কয়েকদিন আগেই দি লংশিপ নামে একটি বই পড়েছিলেন। সেই বইয়ে রাজা হারাল্ড ব্লুটুথের একটি কাহিনী উল্লেখ ছিল। ম্যাটিসন সেটি জিমকে গল্পের ফাঁকে বলেন। পরে ইতিহাস প্রেমী জিম বাসায় ফিরে দি ভাইকিংস নামে একটি বই পড়েন। সেখানে তিনি রাজা ব্লুটুথের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারেন। যা পরবর্তীতে তারবিহীন এই প্রযুক্তির নামকরণের সময় তার মাথায় আসে।
এক লেখায় জিম বলেন, হারাল্ড ডেনমার্কের বিভিন্ন গোত্রকে একত্রিত করেছিল ও তাদের মধ্যে খ্রিস্টান ধর্মের প্রচার করেছিল। আমার মনে হয়েছিল এ কারণেই, নতুন এই তারবিহীন প্রযুক্তিটির নাম ব্লুটুথ রাখা যেতে পারে। কারণ এ প্রযুক্তি অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন ডিভাইসকে একত্রিত করবে। নামকরণের পাশাপাশি ব্লুটুথ টেকনোলোজির লোগোটিরও কিন্তু রয়েছে একটি বিশেষত্ব।
জিম পরবর্তীতে তার নামকরণটি সবার কাছে উপস্থাপনের জন্য পাওয়ার পয়েন্টে একটি প্রেজেন্টেশন তৈরি করেন। এ সময় তিনি হারাল্ড ব্লুটুথের এক হাতে একটি মোবাইল ফোন ও অন্য হাতে একটি ল্যাপটপ যুক্ত একটি নকল শিলা চিত্রও তৈরি করেন। কিন্তু এর পরও আইবিএমের প্রস্তাবিত নাম PAN (Personal Area Networking) কে নির্বাচিত করা হয়। তবে পরে সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনের (SEO) সময় কিছু সমস্যার কারণে এটি বাতিল করা হয়। ফলে শেষমেশ এই প্রযুক্তির নাম অফিসিয়ালভাবেই ব্লুটুথ রাখা হয়, যা পরবর্তীতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
নামকরণের পাশাপাশি ব্লুটুথ টেকনোলোজির লোগোটিরও কিন্তু রয়েছে একটি বিশেষত্ব। নামকরণের পাশাপাশি ব্লুটুথ টেকনোলোজির লোগোটিরও কিন্তু রয়েছে একটি বিশেষত্ব। এতদিন ধরে হয়তো ব্লুটুথ লোগোটি দেখে আপনি মনে করেছিলেন, এমনি কয়েকটি সরলরেখাকে বিশেষভাবে সাজিয়ে এখানে একটি B তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি তা নয়, উপরের ছবিতে খেয়াল করে দেখুন লোগোর এই B টি আসলে নর্ডিক ভাষার H ও B এর মিলনের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে, যা আসলে Harald Bluetooth এর নামের আদ্যক্ষর। এই দুটি অক্ষরকে একত্র করার ফলে তা একটি B অক্ষরের রূপ নিয়েছে এবং পরিণত হয়েছে আমাদের বর্তমানের বহুল প্রচলিত ব্লুটুথের লোগোতে। হাজার বছর আগে মৃত্যু হলেও এখনও সবার পকেটে পকেটে সেই ভাইকিং রাজা ঘুরে বেড়াচ্ছে।