শনিবার, ২২ জানুয়ারী, ২০২২, ০৫:৪৫:৫৬

পাকিস্তানে যে গোপন রোগ হলে নারীদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়!

পাকিস্তানে যে গোপন রোগ হলে নারীদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়!

এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : প্রসবকালীন জটিল রোগ অবস্টেট্রিক ফিস্টুলায় আক্রান্ত হলে পাকিস্তানে নারীদের অনেক সময় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। বের করে দেওয়া হয় বাড়ি থেকেও। চিকিৎসকরা বলছেন, প্রত্যন্ত পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার আরও উন্নতি প্রয়োজন। জার্মান মিডিয়া ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদনে এ খবর প্রকাশ করেছে

উল্লেখ্য, যোনিপথ, মূত্রাশয় ও মলদ্বারের মাঝখানে কোনো অস্বাভাবিক পথ তৈরি হলে একে প্রসবজনিত ফিস্টুলা বলে। বাংলাদেশে আনুমানিক ৭২ হাজার নারী প্রসবজনিত ফিস্টুলায় ভুগছেন। সারা বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৮০০ নারী অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় অথবা সন্তান প্রসবের সময় মারা যান। পরিণামে বিষণ্নতা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, দারিদ্র্য প্রভৃতি সমস্যায় নারীরা পড়েন। 

পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের ছোট শহর ঘোটকির আলি মেহের গ্রামের বাসিন্দা রেহানা কাদির দাদ। ৩০ বছর বয়সী এই নারী চেয়েছিলেন পড়াশোনা শেষ করে নিজের পছন্দের কোনো কাজ করতে। কিন্তু তৃতীয় সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে আক্রান্ত হন অবস্টেট্রিক ফিস্টুলা নামে জটিল এক রোগে। তাতেই ভেস্তে যেতে শুরু করে তার স্বপ্ন।

অবস্টেট্রিক ফিস্টুলায় প্রতি বছর আক্রান্ত হন এমন হাজারো নারী। এই রোগে দীর্ঘ সময়ের প্রসব যন্ত্রণায় যোনিপথ ও মূত্রাশয়ের মাঝে তৈরি হয় ক্ষত। পাকিস্তানে প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরা এই রোগের যথাযথ চিকিৎসা পান না। বরং নানা রকমের কুসংস্কার ও হেনস্তার শিকার হন।

উচ্চশিক্ষার আশা নিয়ে ২০১২ সালে বিয়ে করেছিলেন রেহানা। কিন্তু রাতারাতি তা দুঃস্বপ্নে পরিণত হয় তার জন্য। প্রায়ই মারধর করতেন তার স্বামী। তারপরও পরিবারের সম্মানের কারণে সবকিছু মেনে নিয়েছিলেন মুখ বুজে। কিন্তু ২০২০ সালের নভেম্বরে তৃতীয় সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে সমস্যা আরও জটিল হয়ে পড়ে।

তিনি জানান, প্রসবের সময় তার অস্ত্রোপচার বেশ জটিল ছিল। একজন নার্সের ভুলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ শুরু হয়। এ সময় মারাত্মক যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন তিনি। বারবার স্বামীকে বলছিলেন, তার নিশ্চয়ই কোনো সংক্রমণ হয়েছে। কিন্তু এ কথা শুনে স্বামী তাকে উল্টো মারধর করেন। লাথি মারেন রেহানার পেটে। এ কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন রেহানা। তিনি জানতেন না অবস্টেট্রিক ফিস্টুলা আসলে কী, কিন্তু তার গ্রামের অন্য নারীদেরও এমন সমস্যা ছিল।

অবস্টেট্রিক ফিস্টুলা নারীদের লজ্জা: রেহানা বলেন, তিনি ফিস্টুলা আক্রান্ত হয়েছেন তা জানার পর সবাই তাকে অসম্মান করতে শুরু করেন। তাকে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপ, হাসিঠাট্টা চলত সবসময়। কটাক্ষ করে লোকজন বলতেন, রেহানা মা হতে পারবেন না, তাই তিনি আর সম্পূর্ণ নারী নন। এই রোগে মূত্রত্যাগ ও মলত্যাগ সংক্রান্ত সমস্যা হয়। আচমকা মূত্রত্যাগ করে ফেললে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন হাসাহাসি করতেন। একাধিকবার পরনের কাপড় কাচতে হতো তার বোনকে, ঘটনাচক্রে যিনি রেহানার নিজের জা।

রেহানার বাবা তাকে চিকিৎসার জন্য সিন্ধু ও পাঞ্জাব প্রদেশে নিয়ে গিয়েছিলেন। বাসচালকরা পর্যন্ত রেহানার শরীর খারাপ জেনে অপমান করেছিল। নীরবে চোখের জল সহ্য করে যান তিনি। করাচির কুহি গোথ নারী হাসপাতালে ২০২১ সালের মার্চে তার অস্ত্রোপচার হয়। তিনি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ এবং ধাত্রীবিদ্যায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তার মতো সমস্যায় যাতে অন্যরা না পড়েন সেজন্য সচেতনতা গড়ে তুলতে চান তিনি।

তিন সন্তানের মধ্যে দুই সন্তানকে রেহানার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন তার স্বামী। মাসের পর মাস এই দুই সন্তানকে দেখেননি তিনি। এন্ডোস্কোপিক শল্য চিকিৎসক এবং নারী ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞ সানা আশফাক বলেন, রেহানার মতো একাধিক পাকিস্তানি নারী প্রতিনিয়ত এমন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের বেশিরভাগের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। অবস্টেট্রিক ফিস্টুলা হওয়ার পর বেশিরভাগ নারীই তাদের পরিবার, বিশেষ করে শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হন। বাসচালকরা পর্যন্ত বাস থেকে নামিয়ে দেন এই নারীদের। তাই রাস্তাঘাটে যাতায়াত করাও যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে তাদের জন্য।

করাচির স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসক শাহিন জাফর জানান, অনেকে এই রোগকে ঈশ্বরের অভিশাপ বলেন, কেউবা বলেন দুষ্ট আত্মা ভর করেছে ওই নারীদের শরীরে। ভুক্তভোগী বেশিরভাগ নারী পাকিস্তানের প্রত্যন্ত এলাকার বাসিন্দা। হাসপাতালে আসার সামান্য অর্থটুকুও তাদের নেই। দেশটিতে এই রোগের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেই পাকিস্তানি মুদ্রায় ২০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার রুপি খরচ হয়। জটিল অস্ত্রোপচারে খরচ আরও বেশি।

গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নার্সরা অনেক ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত নন। এর ফলে প্রভাব পড়েছে স্বাস্থ্যব্যবস্থায়। এই রোগ নিয়ে গবেষণা চলছে বলেও জানান জাফর। প্রতি বছরে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার নারী অবস্টেট্রিক ফিস্টুলায় আক্রান্ত হন পাকিস্তানে। জাফর বলেন, ‘কুহিরে একটি মাত্র হাসপাতালে আমরা প্রতি মাসে প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন নারীর চিকিৎসা করি, ২২ কোটির দেশে যা খুবই নগণ্য।’

উল্লেখ্য, মাতৃত্ব হচ্ছে একজন নারীর পূর্ণতা ও তাঁর জীবনের সবচেয়ে মধুর অভিজ্ঞতা। একজন নারীর গর্ভাবস্থার সময়টা আশা ও আনন্দে পরিপূর্ণ থাকে। তবে হাজারো নারী এবং শিশু নিরাপদ মাতৃত্বের প্রতিশ্রুতি ও সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সারা বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৮০০ নারী অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় অথবা সন্তান প্রসবের সময় মারা যান। শুধু বাংলাদেশে এ রকম মাতৃমৃত্যু হয় প্রতিদিন গড়ে ১৫টি। আর যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে অন্তত ২০ জন বা এরও বেশি মারাত্মক জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

এ কথা সত্যি যে অধিকাংশ মাতৃমৃত্যু এবং মাতৃত্বজনিত অসুস্থতা প্রতিরোধ করা যেতে পারে, যদি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও চিকিৎসা সময়মতো নেওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে মূল বাধা হচ্ছে, সন্তান প্রসবের আগে, প্রসবকালে ও পরে মায়েদের মানসম্মত পরিচর্যার সুযোগ না থাকা এবং এ বিষয়ে তথ্য ও জ্ঞানের অভাব। প্রসবকালীন জটিলতায় সবচেয়ে গুরুতর ও বেদনাদায়ক যেসব ক্ষতি নারীর হয়ে থাকে, সেগুলোর একটি হলো প্রসবজনিত (অবস্টেট্রিক) ফিস্টুলা। বাংলাদেশে আনুমানিক ৭২ হাজার নারী প্রসবজনিত ফিস্টুলায় ভুগছেন।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে