বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৭, ০৯:০৪:২৭

‘কীভাবে বঙ্গবন্ধুকে দাফন করেছিলাম, সে কথাটি প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই’

‘কীভাবে বঙ্গবন্ধুকে দাফন করেছিলাম, সে কথাটি প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই’

হেমন্ত বিশ্বাস, গোপালগঞ্জ থেকে : আমার একটাই আশা প্রধানমন্ত্রীকে বঙ্গবন্ধুর লাশটি কেমন দেখেছি তা নিয়ে কথা বলতে চাই। আমি বঙ্গবন্ধুর কফিন বক্স খোলেছি। বঙ্গবন্ধুকে কেমন দেখেছি সে কথাটি প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই।

এতোগুলো বছর হয়ে গেল প্রধানমন্ত্রী একবারও আমাকে জিজ্ঞেস করলেন না, কীভাবে বঙ্গবন্ধুকে দাফন করলাম! তিনি তো কত মানুষের কাছে কত কথাই শুনেন কিন্তু আমরা দাফন করলাম আমাদের কাছ থেকে কোন কথায় শোনলেন না। আমি প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলতে চাই।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ৫৭০ সাবানে গোসল করিয়ে রিলিফের কাপড়ের কাফন দিয়ে সমাহিত করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট টুঙ্গিপাড়ায় তাকে দাফন করা হয়। জানাজায় গ্রামবাসী অংশগ্রহণ করতে চাইলেও দেওয়া হয়নি।

জানা গেছে, ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট দুপুরে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে করে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর লাশ এসে পৌঁছায়। কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে হেলিকপ্টার থেকে কফিন নামিয়ে টুঙ্গিপাড়া সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার কাসেম, আব্দুল হাই মেম্বর, আকবর কাজী, মো. ইলিয়াস হোসেন, জহর মুন্সি, সোনা মিয়া কবিরাজ, শেখ নুরুল হক গেদু মিয়া, সোহরাব মাস্টার আয়ুব আলী শেখসহ অন্যরা তার পৈতৃক বাড়িতে লাশ বহন করে আনেন।

কফিন খুলে লাশ বের করে ৫৭০ সাবান দিয়ে গোসল করানো হয়। রেডক্রিসেন্টের রিলিফের কাপড় দিয়ে কাফন পরানো হয়। জানাজা শেষে পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা শেখ সায়েরা খাতুনের কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।

জানাজা ও দাফন শেষে বিশেষ মোনাজাত পরিচালনা করেন মরহুম মৌলভী আব্দুল হালিম। দাফন অনুষ্ঠানে টুঙ্গিপাড়া, পাটগাতী ও পাঁচকাহনিয়া গ্রামের ৩০/৩৫ জন অংশ নেন। সেনা ও পুলিশ হেফাজতে তড়িঘড়ি করে দাফন সম্পন্ন করা হয়। জানাজায় গ্রামবাসী অংশগ্রহণ করতে চাইলেও দেওয়া হয়নি।

বঙ্গবন্ধুর কফিন বাক্স খোলেন টুঙ্গিপাড়া গ্রামের ১৭ বছরের তরুণ কাঠমিস্ত্রী আয়ুব আলী শেখ। এখন প্রায় ৫৯ বছরের প্রবীণ তিনি। অর্থের অভাবে দুই ছেলেকে উচ্চশিক্ষা দিতে পারেননি। এক ছেলে এসএসসি পাশ করে এক কোম্পানিতে কাজ করছে। অপর ছেলেকে পড়াতেই পারেননি। নাই কোন মোবাইল। অভাব অনটনের মধ্যে কাটছে দিনরাত। বঙ্গবন্ধুর হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলার আকাশে যে কালো মেঘ জমেছিল তা তার পরিবারকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে এখনো।

তিনি বলেন, কফিন খোলার জন্য আমার বাবা মরহুম হালিম শেখ ও আমাকে ডাকা হয়। আমি কফিন খুলেই বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। তখনও আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না আমাদের প্রিয় বঙ্গবন্ধু মারা গেছেন। মনে হচ্ছিল, তিনি ঘুমিয়ে আছেন। কিছু সময় আমি কাজের প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়ি। সেনা সদস্যরা দ্রুত কাজ করার জন্য ধমক দিলে আমার চেতনা ফিরে আসে। এ ঘটনার পর বেশ কয়েক রাত আমি ঘুমাতে পারিনি। বঙ্গবন্ধুর দাফনে অংশ গ্রহণকারীরা প্রায় সবাই মারা গেছেন। আমিসহ ৩/৪ জন এখনও বেঁচে আছি।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আসা সেনা সদস্যরা কফিনসহ লাশ কবর দেওয়ার কথা বলেন। মরহুম মৌলভী আব্দুল হালিম লাশ না দেখে দাফন করতে আপত্তি জানান। একজন মুসলমানকে ইসলামী বিধি-বিধান মেনে দাফনের দাবি জানান। সেনা অফিসাররা ১৫/২০ মিনিটের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর লাশ দাফনের নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধুর কফিন খোলা হয়।

তার বুকে ১৮টি গুলির চিহ্ন ছিল। গুলিগুলো বুক দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বের হয়ে গেছে। ডান হাতের তালুতে একটি গুলি। বাঁ পায়ের গোড়ার পাশে একটি এবং দুই রানের মধ্যখানে দুইটি গুলি। তখনও তার শরীর দিয়ে রক্ত ঝরছিল। গায়ে ছিল সাদা গেঞ্জি ও পাঞ্জাবি। পরনে ছিল সাদা চেক লুঙ্গি। পাঞ্জাবির এক পকেটে ছিল চশমা ও প্রিয় পাইপ।

আমাকে দিয়ে কফিন খুলিয়ে লাশ বের করে। আশরাফ মোল্লার দোকান থেকে একটি ৫৭০ সাবান কিনে আনা হয়। এ সাবান দিয়ে মন্নাফ শেখ, সোনা মিয়া, ইমান উদ্দিন গাজী বঙ্গবন্ধুকে গোসল করান। টুঙ্গিপাড়া শেখ সাহেরা খাতুন রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল থেকে রিলিফের মাল শাড়ি আনা হয়। শাড়ির লাল ও কালো পাড় ছিড়ে ফেলে কাফনের কাপড় বানানো হয়। এ কাপড় পড়িয়ে জানাজা করা হয়। জানাজা শেষে বঙ্গবন্ধুকে বাবা ও মায়ের কববের পাশে চির নিদ্রায় শায়িত করা হয়।

একজন রাষ্ট্রপ্রধানের মৃত্যুর পর যে রাষ্টীয় সম্মান পাওয়ার কথা ছিল, সেটা বঙ্গবন্ধু পাননি। দাফন শেষ হওয়ার পর আর্মি অফিসাররা সারিবদ্ধ হয়ে তাকে তিনবার স্যালুট করেন। লাশ দাফন শেষে সেনা সদস্যরা ডায়রিতে শেখ আব্দুল মান্নাফের স্বাক্ষর নিয়ে চলে যান।

কাদঁতে কাদঁতে এভাবেই সেদিনের স্মৃতিচারণ করছিলেন কাঠমিস্ত্রী আয়ুব আলী শেখ। তিনি বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্য শেখ হাসিনার সাথে একবার দেখা করতে চান। তিনি বলতে চান আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কফিন খুলেছি এবং তার জানাজায়সহ তার দাফনে ছিলাম।
 
এমটিনিউজ/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে