শনিবার, ০৮ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:৫৪:৩০

নিজের বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে দিয়ে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়া সেই মেয়েটি

নিজের বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে দিয়ে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়া সেই মেয়েটি

ঝালকাঠি থেকে: বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ শব্দটিও যেন না থাকে—এই চাওয়া বালিকা শারমিনের। নিজের বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অব কারেজ (আইডব্লিউসি) ২০১৭’ পুরস্কার পাওয়া বাংলাদেশের ঝালকাঠির মেয়ে শারমিন বলেছে, এই পুরস্কার শুধু তার নিজের নয়, পুরস্কারটি দেশের সব মেয়ের জন্য। সে চায়, অন্য মেয়েরাও তার মতো বাল্যবিবাহের প্রতিবাদ করুক।

বাংলাদেশ সময় গত ২৯ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্পের হাত থেকে পুরস্কারটি গ্রহণ করে এসএসসির ফলের অপেক্ষায় থাকা শারমিন। গত বৃহস্পতিবার সে দেশে ফেরে। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর উত্তরায় একটি রেস্তোরাঁয় কথা হয় শারমিনের সঙ্গে। তখন সে বলেছে পুরস্কার পাওয়ার পর নিজের অনুভূতি, চাওয়া, ভবিষ্যৎ চিন্তাভাবনাসহ নানা কিছু। শারমিন বলে, তার এই পুরস্কার পাওয়ার বিষয়ে প্রতিবেদন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

গত বছর ৮ নভেম্বর নারীমঞ্চ পাতায় ‘সাহসী এক শারমিনের কথা’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে শারমিনের বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে দেওয়ার ঘটনা তুলে ধরা হয়েছিল। এরপর গত বছর ‘অধিনায়ক ও নায়কেরা’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্রে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার প্রিয় চার নায়কের সংগ্রামী জীবনের ঘটনা তুলে ধরা হয়। এই চার নায়কের একজন ছিল শারমিন।

রেদওয়ান রনি এই প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণ করেন। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রামাণ্যচিত্রটি দেখানো হয়। পরে প্রামাণ্যচিত্রটি বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং টেলিভিশন চ্যানেলে দেখানো হয়।
শারমিন আক্তার ২০১৫ সালে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় তার মা তাকে জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। বিয়ে না করে সে বান্ধবীর সহযোগিতায় থানায় গিয়ে মা এবং যার সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে মামলা করে। এবার শারমিন এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে।

যখন মায়ের বিরুদ্ধে মামলা করতে যাচ্ছিল, তখন পুরস্কার, স্বীকৃতি, পরিচিতি—এসব কোনো কিছুই ছোট্ট শারমিনের মাথায় ছিল না। ভালো করে বুঝেও উঠতে পারেনি, আসলে সে কত বড় সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। তখন শুধু মনে হচ্ছিল, তার প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে। এখনই সে বিয়ে করতে চায় না। পড়ালেখা চালিয়ে যেতে চায়।
পুরস্কার পাওয়ার অনুভূতি জানাতে গিয়ে শারমিন বলে, ‘এটা শুধু আমার জন্য না, আমার দেশের সব মেয়ের জন্য। আমি চাই ওরা আমার মতো কিছু করুক, প্রতিবাদ করুক।’
শারমিন কল্পনাও করতে পারেনি এ ধরনের একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাবে। সে চায় তার এই ঘটনা সবাই জানুক। তবে এটি আত্মপ্রচারের জন্য নয়। প্রতিরোধ শক্তিশালী করার জন্য। যেন বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে মেয়েরাই এগিয়ে আসে। শারমিনের চাওয়া—বাল্যবিবাহ শব্দটিও বাংলাদেশে যেন না থাকে।

সে বলছিল, ‘বাংলাদেশের মেয়েদের জন্য আমার একটাই মেসেজ—তারা যেন নিজেদের অসহায় মনে না করে, নিজের প্রতি বিশ্বাস থাকে, সাহস থাকে। তাহলে তারা নিজেদের বাল্যবিবাহ আটকাতে পারবে। অন্য পাঁচটি মেয়েকে সাহায্য করতে পারবে। আমি চাই, ওরা আমার মতো কিছু করুক। এ দেশে বাল্যবিবাহ শব্দটি শেষ হয়ে যাক।’
সম্প্রতি পাস হওয়া বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন বিষয়ে জানতে চাইলে শারমিন বলে, আইন হয়েছে তা সে জানে। তবে এই আইনের বিষয়ে কিছু বলতে চায় না।
শারমিন চায় লেখাপড়া চালিয়ে যেতে। স্বপ্ন—বড় হয়ে আইনজীবী হবে। সে সব সময় চেষ্টা করবে মেয়েদের সাহায্য করতে। বিশেষ করে বাল্যবিবাহ ঠেকানোর কাজে সাহায্য করতে। এখন এসএসসি পরীক্ষার ফলের অপেক্ষায় আছে। আশা করছে জিপিএ-৫ পাবে। ফল ভালো হলে ঢাকায় এসে কলেজে পড়তে চায়।


শারমিন জানায়, যুক্তরাষ্ট্র তাকে বলেছে, যেকোনো ধরনের সহায়তা তারা তাকে করবে। শারমিন যদি বাংলাদেশে থাকতে নিরাপদবোধ না করে, তাহলে সে যুক্তরাষ্ট্রেও থাকতে পারে। জবাবে শারমিন বলেছে, বাংলাদেশেই থাকবে। বাংলাদেশে থেকে পড়ালেখা করবে।
শারমিন বলে, যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে যখন সে দেশের ফার্স্ট লেডির হাত থেকে পুরস্কারটি নেয়, তখন তার অনেক ভয় করছিল। কিন্তু ফার্স্ট লেডি তার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেছেন। সাহস দিয়েছেন। পরে সে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গায় ঘুরেছে।

একটি বিদ্যালয়েও তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে। বিদ্যালয়ে মেয়েরা তার কাছে জানতে চেয়েছে, সে যুক্তরাষ্ট্রের মেয়েদেরও বিপদ হলে সাহায্য করবে কি না। সে বলেছে, করবে।
এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পরিচিত ঝালকাঠির একদা অখ্যাত এক বালিকা শারমিন। কিন্তু এখনো সে শিউরে ওঠে ওই দিনগুলোর কথা মনে হলে।

২০১৫ সালের নিজের বাল্যবিবাহ ঠেকানোর ঘটনা বর্ণনা করে শারমিন জানায়, এখনো তার মায়ের বিরুদ্ধে করা মামলাটি চলছে। মায়ের সঙ্গে এখন তার কোনো সম্পর্ক নেই। তার বাবা, দাদি, ফুফু—সবাই তার সঙ্গে আছেন। এখন সে ঢাকায় ফুফুর বাসায় আছেন।
শারমিন বলে, পুরস্কার ঘোষণার পরও সে বুঝতে পারছিল না এর গুরুত্ব। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর অন্য আরও ১২টি দেশের মেয়েদের সঙ্গে যখন আন্তর্জাতিক এই পুরস্কারটি নেয়, তখন মনের ভেতর গর্ব অনুভব হচ্ছিল।
ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সত্যনগর গ্রামের সৌদিপ্রবাসী কবির হোসেনের মেয়ে শারমিন।

 তার মায়ের নাম গোলেনূর বেগম। শারমিন তখন রাজাপুর পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী। শারমিনকে কিছু না জানিয়েই মা তার বিয়ে ঠিক করেন প্রতিবেশী স্বপন খলিফার (৩২) সঙ্গে। এই সিদ্ধান্তে রাজি না হওয়ায় নানাভাবে চাপ ও শারীরিক নির্যাতন নেমে এসেছিল তার ওপর।

এক রাতে স্বপনকে ঘরে এনে শারমিনকে তার মা বলেন, স্বপন শারমিনের স্বামী। শারমিন গতকাল সে ঘটনার বর্ণনায় বলছিল, ‘...এই ছেলে তোর হাসবেন্ড। আমি বলি, আমি তো জানি না। ওই রাতে ওই ছেলে আর আমার আম্মু আমাকে অনেক মারধর করে।’

প্রসঙ্গত, ২০০৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশ্বের ৬০টির বেশি দেশের ১০০ জনের বেশি নারীকে উইমেন অব কারেজ সম্মানে ভূষিত করে। যাঁরা শান্তি, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নে ব্যতিক্রমী সাহসিকতা এবং অনেক সময়ই জীবনের ঝুঁকি প্রদর্শন করে, তাঁদের এই পুরস্কার দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ ছাড়াও এ বছর বতসোয়ানা, কলম্বিয়া, কঙ্গো, ইরাক, নাইজার, পাপুয়া নিউগিনি, পেরু, শ্রীলঙ্কা, সিরিয়া, তুরস্ক, ভিয়েতনাম ও ইয়েমেনের ১২ জন নারী নিজ নিজ কাজের জন্য ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অব কারেজ পুরস্কার পেয়েছেন।
শারমিন জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার নেওয়ার কথা ছিল।

তিনি দেশের বাইরে থাকায় ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প পুরস্কার তুলে দেন।
এমটিনিউজ২৪ডটকম/এম.জে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে