শুক্রবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ০৯:২০:২৭

হারুন আমার কাজ শেষ, তুমি তোমার জিনিস বুঝে পেয়েছ? ভয়ঙ্কর করুণ এক কাহিনী…

হারুন আমার কাজ শেষ, তুমি তোমার জিনিস বুঝে পেয়েছ? ভয়ঙ্কর করুণ এক কাহিনী…

মুন্নির অনুরোধ ফেলতে পারে না মালা। প্রিয় বান্ধবীর ছোট্ট অনুরোধ কী করেই বা ফেলে। এতকরে বলছে যখন, আজ রাতে থাকবে ওদের বাসায়। তা ছাড়া স্কুলের আরও বান্ধবী শেলী, মুক্তা আসবে। সারা রাত আড্ডা দিবে। সকালে স্কুলে না গিয়ে ফাঁকি দিবে। সিনেমা দেখবে। অনেক দিন পর বান্ধবীরা সব এক হবে।

উপরে উপরে মালা আমতা আমতা করলেও ভিতরে সে বেজায় খুশি। বাবাকে রাজি করাতেই হবে। বকা খেলে খাবে। তবুও মুন্নির বাসায় আড্ডাটা ছাড়া যাবে না। মুন্নি সেই দুপুরে এসে বলে গেছে। নানা কিছু ভেবে মালা তার বাবাকে রাজি করাল। সন্ধ্যায় বাসা থেকে বেরিয়ে গেল মালা। মুন্নিদের বাসার কাছেই। হেঁটেই পৌঁছে গেল।

কিরে মুন্নি! মুক্তা শেলী এখন তো আসল না! রাত তো অনেক হলো। কখন আসবে ওরা। মালার এমন প্রশ্নে থতমতো খায় মুন্নি। বলে, কী জানি বুঝতে পারছি না। কেন যে আসল না। থাক, না আসলেই বা কী। দুই বান্ধবী মিলে আড্ডা দিব। কতদিন একসঙ্গে বসে দুটো কথা বলিনি। আয় আমরা ভাত খেয়ে নেই। তারপর রুম আটকে আড্ডা দিব। রাত তো ১০টা বেজে গেল। মুন্নির এমন কথাবার্তায় বিরক্ত মালা। প্রকাশ করে না।

সব কাজ শেষে রাত ১১টায় রুমে গিয়ে দুজনে কথা বলতে থাকে। মুন্নি তার জীবনের কিছু অজানা কথা বলতে বলতে কেমন যেন আনমনা হয়ে যায়। মালার মন খারাপ হয়। ভাবে, উপর থেকে মানুষ বোঝা যায় না। মুন্নির ভিতরে এত কষ্ট বোঝা যায়নি। মুন্নির জন্য মায়া হয় তার।

হঠাৎ মুন্নি বলে, চল আমরা বাড়ির বাইরে যাই। খোলা মাঠটায় গিয়ে বসি। মালা বলে, এত রাতে কীভাবে? কিছু হবে না— অভয় দেয় মুন্নি। মুন্নির এই মনের অবস্থার মধ্যে তার কথা ফেলতে পারে না। দুজন বাসা থেকে বেরিয়ে মাঠটায় গিয়ে বসে। অন্ধকার চারদিক। সামনে কিছু দেখা যায় না।

রাত তখন ১২টা। দুজন কথা বলছে। মুন্নি কেমন যেন করছে। আশপাশ মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। কী রে, কিছু খুজছিস নাকি মুন্নি? মালার প্রশ্নে সম্ভিত ফিরে পায় মুন্নি। কই কিছু না তো! কী আবার খুঁজব? কেমন যেন রাগ হয়ে পালটা প্রশ্ন মুন্নির। মালা হতবাক। ঠিক ওই সময়েই অন্ধকারের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসল তিন যুবক। মুন্নির ঠিক পেছনে এসে দাঁড়ায়। বুক কেঁপে ওঠে মালার।

এই আপনারা কারা? কী চান এখানে? মালা প্রশ্ন রাখে। মুন্নি এবার পেছন ঘুরে তাকায়? কিন্তু কিছু বলে না। যুবকদের চেহারা অন্ধকারের মধ্যে চেনা যাচ্ছিল না। কিন্তু মুন্নির চেহারা ঠিক দেখা যাচ্ছে। ওর মুখে হাসি। যে হাসির সঙ্গে পরিচয় নেই মালার। ভয় পায় মালা। কী রে মুন্নি, কথা বলছিস না কেন? মুন্নি মুখ খোলে। বলে, আরে তুই চিনিস না! ভালো করে তাকিয়ে দেখ, চিনবি।

মালা আবার ভালো করে তাকায়! কী ব্যাপার চিনতে পারছ না! এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলা! তিনজনের একজন কথা বলে। মালা এই কণ্ঠটা চেনে। আঁতকে ওঠে মালা। তাহলে কী ও হারুন। যে কিনা তাকে কয়েক বছর ধরে প্রেম ও বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে আসছে। কিন্তু সে তো তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে বলেও ভয় দেখিয়েছে। তবে কী মুন্নি বিপদে ফেলতে চাইছে তাকে?

মালা ভয় পায়। মালা উঠে দাঁড়ায়। যুবকটি এবার মালার সামনে এসে দাঁড়ায়। হ্যাঁ সেই তো! হারুন! সঙ্গে বুলেট আর জুয়েল। এখন কী করবে! চারদিকে অন্ধকার। দৌড় দিবে! যদি আশপাশের লোকজন চলে আসে, সেটিও কেলেঙ্কারি হবে। ভাবছে মালা এমন নানা কথা।

মুন্নির হাত ধরে মালা। কিন্তু ছাড়িয়ে নেয় মুন্নি। মুন্নি বলে,”হারুন আমার কাজ শেষ। তুমি তোমার জিনিস বুঝে পেয়েছ? এবার আমি যাই। ঘুম পাইছে আমার।”

হারুন বলে, ওকে, তুমি যাও। আমার হিসাব আমি নিব! এমন কথাবার্তায় মালার কান্না আসে। মুন্নির দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছু বলতে পারছে না। মুন্নি নিজের বাসার দিকে হাঁটতে থাকে। মালা দৌড় দেওয়ার চেষ্টা করে। জাপটে ধরে ফেলে হারুন। মুখ চেপে ধরে। তারা মালাকে নিয়ে যায় পাশের একটি নির্জন পুকুরপাড়ে।

হারুন তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। মালার জবাব, রাজি না। ক্ষুব্ধ হয় হারুন। সেখানেই তিনজনে মিলে পালাক্রমে নির্যাতন করে মালাকে। চিত্কার করায় তার মুখে কাপড় গুঁজে দেওয়া হয়। মালা তখন বলে, সব কথা বলে দিবে সে। থানা পুলিশ করবে। কাউকে ছাড়ব না। এ কথা শুনে হারুন আরও ক্ষুব্ধ। শিমুল গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে মালাকে বেঁধে ফেলে। এরপর কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় ধর্ষকরা।

রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে মালার গগন বিদারি চিত্কার আশপাশের লোকজনের কানে পৌঁছে যায়। ছুটে আসে লোকজন, আসে মালার বাবা। ততক্ষণে লাপাত্তা তিন ধর্ষক। মালাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। কিন্তু পরদিন মারা যায় মালা।

২০০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে রংপুরের সদর উপজেলার পালিচরা গ্রামে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতনের পর পুড়িয়ে হত্যা করা হয় মালাকে। তার বাবা দিনমজুর মজিবর রহমান বাদী হয়ে সদর থানায় সাতজনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন।

পুলিশ ঘটনার তদন্ত শুরু করে। পুলিশ জানতে পারে মুন্নির কথা। গ্রেফতার করে মুন্নিকে। বসানো হয় থানার টেবিলের সামনে। জেরা শুরু। কিন্তু মুন্নি তার বান্ধবী মালাকে চেনে না বলে দাবি করে। কিন্তু জেরার মুখে আর কতক্ষণ অস্বীকার করে থাকবে মেয়েটি। যখন বলা হলো, স্বীকার করলে তাকে মামলায় জড়াবে না, তখনই সব ফাঁস। ঘটনার আদ্যোপান্ত বলে দেয়। হারুনের অনুরোধ রাখতেই মালাকে সে তার বাসায় আসতে বলে।

এখন পুলিশ খুঁজতে থাকে হারুন, বুলেট আর জুয়েলকে। কিন্তু ওরা তো লাপাত্তা। পাওয়া যায় না কোথাও। পুলিশ চেহারাও চিনে না। বিভিন্ন জায়গায় সোর্স নিয়োগ করে পুলিশ। বেশ কিছুদিন পর পুলিশের কাছে খবর আসে, হারুনকে দেখা গেছে পাশের একটি গ্রামের বাজারে। পুলিশ ছুটে যায়।

কিন্তু কে হারুন! বিরাট একটা সমস্যায় পড়ে পুলিশ। কাকে ধরবে? অনেক লোকজন সেখানে। চেহারার সঙ্গে মিল পাচ্ছে না কারও। এক সোর্স খবর দিল, হারুনের একটা বদঅভ্যাস আছে। মাথা একটু পর পর ডান দিকে ঝাঁকায়। পুলিশ তীক্ষ নজরে দেখছে। হোটেলের একটা চেয়ারে বসা যুবকের দিকে লক্ষ্য করে।

সন্দেহ হলেও এই যুবকের দাড়ি গোঁফ আছে। কিন্তু হারুনের ছিল না। হঠাৎ মাথা ডান দিকে ঝাঁকাচ্ছে! পুলিশ তখন উত্তেজনায়। আরে পাওয়া গেছে শিকার। যুবকের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। চল, আর খেতে হবে না। খেয়েছিস অনেক। দাড়ি গোঁফ রেখেছিস, তোর বদঅভ্যাস পাল্টাতে পারিসনি। বলে পুলিশ।

যুবকটি আসতে চায় না। হ্যান্ডকাফ পরিয়ে সোজা থানায়। এরপর ছোটদের নামতার মতো পুরো ঘটনা পুলিশ বলে যায় হারুনকে সামনে বসিয়ে। অস্বীকার করার কোনো আর পথ থাকে না। তার দেওয়া তথ্যে পাওয়া যায় বুলেটকে। কিন্তু অধরা জুয়েল।

২০০২ সালের অক্টোবরে রংপুর নারী ও শিশু নির্যাতন আদালত এই তিনজনের ফাঁসির আদেশ দেয়। আর মুন্নিকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন দণ্ড। -বিডি প্রতিদিন

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে