শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৯, ০৯:৩৩:১৬

অন্য নারীদের মতো চুপ থাকেনি নুসরাত

অন্য নারীদের মতো চুপ থাকেনি নুসরাত

নিউজ ডেস্ক : ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির হত্যাকাণ্ড উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে। বিবিসি এক বিশেষ প্রতিবেদনে তাকে নিয়ে শিরোনাম করেছে-যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করায় পুড়িয়ে হত্যা। দেশ রূপান্তর

ব্রিটিশ গণমাধ্যমটি জানায়, ঢাকা থেকে ১৬০ কিলোমিটার দক্ষিণে ছোট শহর ফেনীর একটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ১৯ বছর বয়সী নুসরাত। ২৭ মার্চ তিনি অভিযোগ করেন, মাদ্রাসার প্রধান (অধ্যক্ষ) তাকে নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে গিয়ে যৌন হেনস্তা করেন।

বাংলাদেশের অনেক নারীই পরিবার ও সমাজ দ্বারা লজ্জার ভয়ে যৌন নির্যাতন ও নিপীড়নের ঘটনা গোপন রাখে। সেখানে নুসরাতের ভূমিকা ছিল ভিন্ন। তিনি চুপ করে থাকেন। পরিবারের সহায়তায় স্থানীয় পুলিশ থানায় গিয়ে তিনি মাদ্রাসা প্রধানের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করেন।

থানায় অভিযোগের সময় নুসরাতের মানসিক বিপর্যস্ততার বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে নিয়ম লঙ্ঘন করে তাকে জেরা করেন পুলিশ কর্মকর্তা। সেই জেরা নিজের মোবাইলে ভিডিও করেন তিনি। পরবর্তীতে তা ফাঁস হয়ে পড়ে। তাতে দেখা যায়, নুসরাতকে পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন-এটি তেমন ঘটনা নয়।

নুসরাতের অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২৭ মার্চ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে আটক করে পুলিশ। এরপর মামলা প্রত্যাহারে নুসরাতের পরিবারের ওপর চাপ অব্যাহত থাকে। অধ্যক্ষের মুক্তির দাবিতে কয়েকজন ছাত্র ও স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীরা বিক্ষোভ করে। সমাজ কর্তৃকও ধিক্কারের শিকার হন নুসরাত। একপর্যায়ে তার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ে তার পরিবার।

নিপীড়নের শিকার হয়েও ভুক্তভোগী নারীরা উল্টো হেয় প্রতিপন্নের শিকার হয়, সমাজে এবং অনলাইনেও সমালোচিত হন। অনেক ক্ষেত্রে তাদের জেলেও যেতে হয়। এমনকি সহিংসতার শিকার হতেও হয়। নুসরাতকেও এসবের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।

৬ এপ্রিল সকালে আলিম পরীক্ষা দিতে মাদ্রাসায় গেলে নুসরাতকে এক ছাত্রী ছাদে ডেকে নিয়ে যায়। সেখানে বোরকা, চশমা ও হাতমোজা পরা চার-পাঁচ জন ব্যক্তি তাকে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়। তিনি অস্বীকৃতি জানালে তারা তার গায়ে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, হত্যাকারীরা এ ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু নুসরাত বেঁচে যাওয়ায় তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়। মৃত্যুর আগে সে তার বক্তব্য পুরো ঘটনার বিবরণ দিয়ে যায়।

গায়ে কেরোসিন দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলে নুসরাতের শরীরের ৮০ শতাংশই পুড়ে যায়। স্থানীয় হাসপাতাল থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। অ্যাম্বুলেন্সেই তার ভাইয়ের মোবাইলে ধারণকৃত এক বক্তব্যে নুসরাত বলেন, আমার শিক্ষক আমার শরীর স্পর্শ করেছে। আমি শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ে যাব। এ ভিডিওতে তিনি তার ওপরে হামলাকারীদের কয়েকজনকেও শনাক্ত করে যান।

কিন্তু হাসপাতালে পাঁচদিন পর তার মৃত্যু হয়। ফেনীতে তার জানাজায় হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত ছিলেন। ইতিমধ্যে পুলিশ এ হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। মাদ্রাসা প্রধানের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ আয়োজন করা দুই শিক্ষার্থীকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জেরা করতে গিয়ে হেনস্তা করা সেই পুলিশ কর্মকর্তাকেও ওই থানা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

এ ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিহত নুসরাতের পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় দেখা করেছেন। তিনি তাদের প্রতিশ্রুতি দেন, এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সকল ব্যক্তিকে বিচারের আওতায় আনা হবে।

এদিকে নুসরাত হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে দেশব্যাপী প্রতিবাদ শুরু হয়। নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে।

বিবিসির ফেসবুক পেজে আনোয়ার শেখ নামে এক ব্যক্তি বলেন, আমি সারা জীবন একটি কন্যা সন্তানের বাবা হতে চেয়েছি। কিন্তু আমি এখন ভীত। এ দেশে কন্যা সন্তানের জন্ম দেওয়া মানে সারা জীবন ভীত ও শঙ্কিত থাকা।

নারী অধিকার সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৯৪০টি। গবেষকদের মতে, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে আরও বেশি।-বিবিসি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে