মঙ্গলবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০২১, ০৭:১৪:৩৯

জীবিকার খোঁজে খোলা আকাশের নিচে তিনবারের এমপি-প্রার্থী আছাদুল

জীবিকার খোঁজে খোলা আকাশের নিচে তিনবারের এমপি-প্রার্থী আছাদুল

সালমান তারেক শাকিল: ‘রাজনীতি করতে গিয়ে আমার অর্থনৈতিক অবনতি হয়েছে। এ কারণেই পথে বসে আয় করতে হচ্ছে। আয়-ব্যয় এখন সমান। বাবার পঞ্চাশ বিঘা জমি ছিল, সে জমি কমতে-কমতে ২০/২২ বিঘায় ঠেকেছে’— বলছিলেন এফএম আছাদুল হক। যিনি ৩ বার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রায় পথে বসেছেন। জীবন-সংগ্রাম করতে স্ত্রীর পরামর্শে সাতক্ষীরার তালা থেকে এসেছেন রাজধানীতে।

রাজধানীর পূর্ব পান্থপথ রোডে কাওরানবাজার রেলক্রসিংয়ের দক্ষিণ দিকে (দিলুরোড-হাতিরঝিল অংশে) ফুটপাতের ওপর একটি ছোট টেবিল ও দুটো টোল নিয়ে বসেন এফ এম আছাদুল হক; প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে দশটা আর বিকাল চারটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত প্রাথমিক রোগের চিকিৎসা দেন তিনি। মাঝখানের সময়টিতে কিছুদিন জিএম হিসেবে কাজ করলেও করোনায় হারিয়েছেন সে চাকরিটিও। পরিত্যক্ত বিজিএমইএ ভবনের পেছনের সড়কে গত কোরবানির ঈদের পর থেকে নিয়মিত প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম চালাচ্ছেন আছাদুল হক; আর এই কাজের আয় দিয়েই স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে মগবাজারের দিলুরোড এলাকায় ছোট একটি কক্ষে বসবাস করছেন তিনি।

১৯৯৬ (মিনার মার্কা), ২০০৮ ও ২০১৮ (হাতপাখা মার্কা) সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাতক্ষীরা-১  (তালা-কলারোয়া) আসন থেকে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন এফ এম আছাদুল হক। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার পর থেকে রাজনীতি থেকে সাময়িক অবসর নিয়েছেন তিনি।

মঙ্গলবার (১৯ জানুয়ারি) সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, এফ এম আছাদুল হক ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৩৬৭ ভোট পান, যার শতকরা হার ০.৬২% । এরপর ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট পেয়েছেন ১৭৭৬, শতকরা হারে  ০.৫৭%। সর্বশেষ ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আছাদুল হক পেয়েছেন ১৭৪৯ ভোট, যার শতকরা হার  ০.৫০% ।

করোনার আগে ঢাকায় এলেও গত তিন মাস আগে পরিবার নিয়ে এসেছেন আছাদুল হক। এর আগে, একাদশ নির্বাচনের পর স্ত্রীর পরামর্শে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় আসেন তিনি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের আগে হাতিরঝিলের এফডিসি অংশে বসতেন নিয়মিত, এখন কেবল দিলুরোড এলাকাতেই কাজ করেন আছাদুল হক। সম্প্রতি এক সন্ধ্যায় দিলু রোডের হাতিরঝিল অংশে নিজের কাজের জায়গায় বসে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন নিজের সংগ্রামের কথা। রাজনীতি আর পরিবারের কথাও এসেছে তার ভাষ্যে।

‘পড়াশোনা শেষ করে মাত্র ২৫ বছর বয়সে আমি প্রথম এমপি নির্বাচন করি। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আমার মনোনয়নে মরহুম চরমোনাই পীর ও আল্লামা আজিজুল হকের অবদান আছে। ওই বছর অবশ্য দল থেকে কোনও নির্বাচনি সহযোগিতা আসেনি’— বলেন মাওলানা এফ এম আছাদুল হক। 

তিনি বলেন, ‘বাবার অন্তত ৫০ বিঘা জমি ছিল, সেই জমি কমতে-কমতে এখন ২০-২২ বিঘার মতো আছে। আর টাকা তো অন্তত ১০-১২ লাখ খরচ হয়েছে।’ আছাদুল হক সাতক্ষীরা-১ আসন থেকে টানা ছয়বার ইসলামী আন্দোলনের মনোনয়ন পেয়েছেন। এরমধ্যে নির্বাচনে সরাসরি তিনবার প্রার্থিতা করেন। বিজয়ী হতে পারেননি একবারও। দায়িত্ব পালন করেছেন দলের উপজেলা কমিটির সভাপতি ও জেলা কমিটির সহ-সভাপতি হিসেবে। বর্তমানে দলীয় কার্যক্রম থেকে বিরত রয়েছেন আছাদুল হক।

প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন লাভের গল্প বলেন আছাদুল হক। বলেন, ‘দলের মনোনয়ন বোর্ডই স্থানীয় পর্যায়ে আলোচনা করে প্রার্থী নির্ধারণ করেন। আমাকে ছাড়াই সিলেকশন হতো। নির্ভরযোগ্য মনে করে, তাই প্রার্থী করে।’

‘২০০৮ সালের নির্বাচনে দলের পক্ষ থেকে পোস্টার করে দেওয়া হয়েছিলো। আর ২০১৮ সালের নির্বাচনে আমাকে ও দলের প্রচার-কর্মীদের জন্য কিছু অর্থায়ন করেছিলো দল’ বলেন আছাদুল হক। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে তার অন্তত দুই লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে বলে জানান।

আছাদুল জানান, শিক্ষাগত জীবনে তিনি দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করেছেন প্রথম বিভাগে। আল কোরআনের ওপর গবেষণা করেছেন ভারতের ক্বারী আবুল হাসান আজমী নামক একটি প্রতিষ্ঠান থেকে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে ইমাম প্রশিক্ষণ কর্মসূচি সমাপ্ত করেছেন প্রথম বিভাগ নিয়ে। এই প্রশিক্ষণে তিনি প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা রপ্ত করেছেন।

আপনার ভিজিট কেমন? উত্তরে আছাদুল মুচকি হাসেন; বলেন, ‘যে যেমন দেয়। তবে ২০-৩০ টাকা। অনেক দরিদ্র আছে, তাদের ফ্রিতেই সেবা দিই। আমি মূলত ব্যবসা ও সেবা— দুটোই করি এখানে। এলাকায় (সাতক্ষীরা) তো এটাও হবে না, খ্যাতির বিড়ম্বনা আছে।’

আছাদুল হক বলছিলেন, ‘আমি তো ধনী পরিবারের সন্তান। আমার বাবা এফ এম শওকাত আলীও সচ্ছল। কিন্তু নির্বাচন করতে গিয়ে তার জমি খরচ হয়েছে। আমরা তিন ভাই, তিন বোন। আমার ছোট ও বড় ভাইটিও ভালো আছে। ধনী, শিক্ষিত পরিবারের হলেও নির্বাচন করতে গিয়ে আজকে এই অবস্থা। এখন বয়স আমার ৫১, অর্ধেক জীবনই রাজনীতিতে ব্যয় করেছি।’নিজের দুরবস্থার কথা উল্লেখ করে ইসলামী আন্দোলনের এই নেতা বলেন, ‘আছি কোনওভাবে, দুশ্চিন্তায় আছি। অর্থনৈতিকভাবে সোজা হতে পারলাম না। বাচ্চাগুলোও ছোট (একজন দুই বছর বয়সী, আরেকজন মক্তবে ভর্তি হবে)।

কর্মজীবনে আছাদুল হক খুলনার পাইকগাছার জামিয়া কারিমিয়া ও দাকোপের মহিউসসুন্নাহ মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে নির্বাচন থেকে পেছাবেন না আছাদুল হক। বলেন, ‘আমি সময় পেলেই এলাকার মানুষের খোঁজ রাখি। সংগঠনের খোঁজ রাখি। সামনে একদিন এমপি হবো, লেগে থাকবো, আজীবন।’ নিজের আর্থিক অবস্থার অবনতির জন্য নিজের কৌশলকেই দায়ী করেন আছাদুল হক। বলেন, ‘ব্যবসায়িক কৌশল আর সরলতার জন্য এই অবস্থা।’

উল্লেখ্য, নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রার্থীদের হলফনামা উল্লেখ থাকলেও সংশ্লিষ্ট লিংকটি ক্লিক করে কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। যে কারণে আছাদুল হকের তিনটি সংসদের হলফনামার তথ্য পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মঙ্গলবার (১৯ জানুয়ারি) দুপুরে এফ এম আছাদুল হক বলেন, ‘আমার বাবা-মা তো এখনও জীবিত আছেন। তাদের অধীনে আছি, সে কারণে লিখেছি আমার সম্পদ নেই। ৯৬ এ নির্বাচনে দিয়েছিলাম, স্থাবর সম্পত্তি নেই। ২০০৮ এ এসেও একই দিয়েছি, কিছু নাই। ২০১৮ সালের নির্বাচনে এসে ঘরের আসবাবপত্র আর স্ত্রীর সামান্য স্বর্ণালঙ্কারের কথা হলফনামায় উল্লেখ করেছি।’-বাংলা ট্রিবিউন

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে