সংঘর্ষের মধ্যে গলায় এসে একটি গুলি লাগে, ছেলের মরদেহ না দেখার আক্ষেপ মায়ের

এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক: গত ১৯ জুলাই শুক্রবার সকালে দোকানের উদ্দেশ্যে বাসা বের হন মো. মোসলে উদ্দিন। ঢাকার বনশ্রী এলাকায় দোকানের কাছেই মসজিদের জুমার নামাজ পড়েন। নামাজ শেষে বড় ভাই কামাল বলেছিলেন, ‘বাহিরের অবস্থা ভালো না চল বাসায় যাই’। বড় ভাইকে বলেছেন, 'আমি ছেলের জন্য দোকান থেকে কলা নিয়ে বাসায় আসতেছি।

কলা আনতে গিয়েই সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গলায় গুলিবিদ্ধ হন ভোলার লালমোহন উপজেলার পশ্চিম চর উমেদ ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মৃত হানিফ মিয়ার ছেলে মো. মোসলে উদ্দিন। শহীদ মোসলে উদ্দিন ঢাকার বনশ্রী এলাকায় লন্ড্রির দোকানের ব্যবসা করতেন। শহীদ মোসলে উদ্দিনের কাছে ঢাকার ভাড়া বাসায়ই থাকতেন মা রোকেয়া বেগম। মারা যাওয়ার এক মাস আগে তিনি খিলখেত মেয়ের বাসায় বেড়াতে যান।

ছেলে মোসলে উদ্দিন মারা যাওয়ার সংবাদ শোনার পর রাস্তার অবস্থা খারাপ থাকায় তিনি ছেলের লাশটিও দেখতে পারেননি। মারা যাওয়ার পর ছেলের মরদেহটি না দেখার আক্ষেপ মা রোকেয়া বেগমের। এমনকি রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষের কারণে শহীদ মোসলে উদ্দিনের মরদেহটি গ্রামের বাড়িতেও নেওয়া সম্ভব হয়নি। বাধ্য হয়ে বনশ্রী এলাকার একটি কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

শহীদ মোসলে উদ্দিনের মা রোকেয়া বেগম কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, তার চার ছেলে দুই মেয়র মধ্যে মোসলে উদ্দিন ছিলেন তৃতীয়। নদী ভাঙার কারণে ভিটেমাটি হারিয়ে অনেকটা নিঃস্ব হয়ে যান তারা। সংসারের অভাবের কারণে ছেলে মোসলে উদ্দিন ছোট বেলায় তার মামার সঙ্গে ঢাকায় চলে যায়। ঢাকায় একটি মাদ্রসায় হেফজখানায় পড়েছেন। হেফজ শেষ করার পর ঢাকার তামিরুল মিল্লাত মাদ্রসায় পড়ালেখা করেন। সেখান থেকে আলিম শেষ করেন ২০০৭ সালে।

এর পর ফাযিলে ভর্তি হয়েও আর পড়ালেখা করেননি। এর পর দুবাই চলে যায় সে। পরবর্তীতে দুই-তিন বছর দুবাই থেকে বাড়িতে চলে আসে। কোনো উপায় না পেয়ে আবারও ঢাকায় ব্যবসা করতে চলে যায়।

২০১২ সালে বিয়ে করেন মোসলে উদ্দিন। তার সংসারে আফফান নামের ১১ বছর বয়সী একজন ছেলে রয়েছে। তবে জন্মগতভাবেই সে শারিরিক প্রতিবন্ধী। অন্যের সহযোগীতা ছাড়া সে কিছুই করতে পারেন না। তার স্ত্রী নাসরিন আক্তার সাত মাসের অন্তসত্বা। ১৯ জুলাই শুক্রবার সকালে নাস্তা করে বাসা থেকে দোকনের উদ্দেশ্যে চলে যান। দুপুরে জুমার নামাজ পড়ে আবার বাসায় আসার কথা ছিল। কিন্তু নামাজ শেষ করে তার বড় ভাই কামাল তাকে বাসায় আসতে বলেছেন। সে ছেলের জন্য কলা কিনতে দোকানে যান। এ সময় সংঘর্ষের মধ্যে তার গলায় এসে একটি গুলি লাগে। 

পরে ছাত্ররা তাকে উদ্ধার করে বনশ্রীর ফরাজী হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। হাসপাতাল থেকে বাসায় ফোন দিয়ে জানানো হয় মোসলে উদ্দিন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। তার লাশ হাসপাতালে রয়েছে। এ অবস্থা স্ত্রী নাসরিন ও বড় ভাই কামাল মিলে হাসাপাতাল থেকে মরদেহ নিয়ে এসে বনশ্রীর একটি গোরস্থানে দাফন করেন। 

সে সময় রাস্তার মোড়ে মোড়ে গণ্ডগোলের কারণে মা রোকেয়া বেগম ছেলের লাশটিও দেখতে পারেনি। মারা যাওয়ার তিন দিন পর খিলখেতে মেয়ের বাসা থেকে ছেলের বাসায় আসেন। তিনি ছেলে হত্যার বিচার দাবি করেন।

শহীদ মোসলে উদ্দিনের স্ত্রী নাসরিন আক্তার জানান, স্বামী মোসলে উদ্দিনের লন্ড্রির দোকান ছিল। আর সে নিজে টিউশনি ও সেলাইয়ের কাজ করতেন। দুইজনের আয়ের টাকায় তাদের সংসার চলতো। তাদের একমাত্র ছেলে আফফান জন্মের পর থেকেই শারিরিক প্রতিবন্ধী। তাকে সারা বছর ওষুধ খাওয়াতে হয়। ওষুধ খাওয়ালে সে মোটামুটি সুস্থ্য থাকে, না খাওয়ালে অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। 

স্বামী মারা যাওয়ার সময় স্ত্রী নাসরিন তিন মাসের অন্তসত্বা ছিলেন। মারা যাওয়ার পর মানুষের দেওয়া অনুদানের টাকায় তার রেখে যাওয়া তিন লাখ টাকা ঋণ পরিশোধ করেছেন। এখন নিজের টিউশনি ও বাসায় সেলাইয়ের কাজের টাকায় কোনোমতে তাদের সংসার চলছে। 

স্বামীকে হারিয়ে প্রতিবন্ধী ছেলে ও অনাগত সন্তান নিয়ে দুঃখের সাগরে ভাসছেন স্ত্রী নাসরিন আক্তার। তিনি সরাকরের কাছে স্বামী হত্যার বিচারের পাশাপাশি তার প্রতিবন্ধী ছেলে ও অনাগত সন্তানের জীবনের নিশ্চয়তা দাবি করেন।