মঙ্গলবার, ১১ জুন, ২০১৯, ০১:৩৮:০৬

মাশরাফির সমালোচনার আগে একটু ভাবুন

মাশরাফির সমালোচনার আগে একটু ভাবুন

সামন হোসেন: জীবনের মায়া কার নেই? উত্তরটা হওয়া উচিত, সবারই আছে। কিন্তু সে উত্তরটা বারবার কঠিন করে দিয়েছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। এই ক্রিকেট খেলেই সাতবার ছুরি কাঁচির নিচে শুয়েছেন। ডাক্তারও তাকে সাবধান করে দিয়েছেন বারবার। সামান্য অসতর্কতায় চিরতরে পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! শরীরের নানা জায়গায় ইনজুরি নিয়ে বীরের বেশে বাংলাদেশের জার্সি গায়ে ঠিকই মাঠে ফিরে এসেছেন। ঘটাচ্ছেন অসাধারণ সব কাণ্ড। তার নেতৃত্বে ওয়ানডে ইতিহাসে সর্বাধিক ম্যাচ জিতেছে বাংলাদেশ।

তার হাত ধরেই প্রথম আন্তর্জাতিক ট্রফির স্বাদ পেয়েছে লাল সবুজের প্রতিনিধিরা। মাত্র দুটি ম্যাচে খারাপ বোলিং করায় তাকেই কিনা গালি দিচ্ছি?

এবারের বিশ্বকাপের সবগুলো উইকেট ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি। এখন পর্যন্ত যতগুলো ম্যাচ হয়েছে প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই তুলোধুনো হয়েছেন বিশ্বের বাঘা বাঘা বোলাররা। মাশরাফিও হয়তো ভালো বল করতে পারছে না। তাই বলে মাত্র দুই ম্যাচের ব্যবধানে আমরা অতীত ভুলে যাব? আমরা কি একটু ভেবেছি ১৮ বছরের ক্যারিয়ারে ১১ বার চোটের কারণে দলের বাইরে যেতে হয়েছে এই মাশরাফিকে। ২০০৯ সালে নেতৃত্বের গুরুদায়িত্ব কাঁধে বর্তালেও ইনজুরি তাকে মাঠ থেকে ছিটকে দিয়েছে বারবার। ঘরের মাঠে ২০১১ বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন থাকলেও, দল থেকে ছুড়ে ফেলা হয় তাকে। সেদিন মাশরাফির চোখের পানি কাঁদিয়েছিল এ দেশের প্রায় সকল ক্রিকেটপ্রেমীকেই। তবুও মাশরাফি হারেন না। হারতে জানেন না। বার বার ফিরে আসেন। 

এমন অদম্য এক ক্রিকেটারের হাতেই ২০১৪ সালের এক সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশের ক্রিকেটের রঙিন জার্সির দুটি ফরমেটের দায়িত্ব তুলে দেয়া হয়। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরের ঘটনা এটি। এরপর কেবলই বাংলাদেশ ক্রিকেটে স্বপ্নময় এক অভিযাত্রা। স্বপ্নের চেয়েও দামি কয়েকটি সিরিজ কাটানো। তার নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব এবং ব্যক্তিত্বে ক্রিকেট ইতিহাসের স্বর্ণ শিখরেই যেন এখন বাংলাদেশ। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে তার অধীনেই ভিন্ন বাংলাদেশকে দেখে ক্রিকেট বিশ্ব। ২০১৭ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সেমিফাইনাল খেলে সবাইকে চমকে দেয় টাইগাররা। এই আসরেও নেতা মাশরাফি। 

গত বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দশ শীর্ষ উইকেট সংগ্রাহকের তালিকায় ছয় নম্বরে ছিলেন টাইগার অধিনায়ক। ১৮ ম্যাচে ১৮ উইকেট নিয়েছেন মাশরাফি। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা বোলারও তিনি। ২১১টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে মাশরাফির সংগ্রহ ২৬৫ উইকেট। যা বাংলাদেশি বোলারদের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১৪ সালে অধিনায়কত্ব নেবার পর ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারিও মাশরাফি। এ সময়ে মাশরাফির ৯২, মোস্তাফিজের ৮৬, সাকিবের ৮১ শিকার। যে ইনজুরির সঙ্গে মাশরাফির এতো সখ্যতা, সে ইনজুরির কারণে এ সময়কালে একটি ওয়ানডতেও মিস করেননি মাশরাফি। ২০১৫ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ খেলেননি ধীরগতির ওভাররেটের কারণে সাসপেনশনের আশঙ্কায়। আশঙ্কা সত্যি করে বিশ্বকাপের পর পর পাকিস্তানের বিপক্ষে এবং ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির আগের ত্রিদেশীয় সিরিজের প্রথম ম্যাচে দুই দফায় দুটি ম্যাচ খেলতে পারেননি। দুই হাঁটুতে সাত অপারেশনের ধকল নিয়েও বাকি বাংলাদেশের ৭৩ ওয়ানডেতে মাশরাফির খেলেছেন লাল সবুজের জার্সিতে।

মাশরাফি বাংলাদেশের প্রথম স্পিডস্টার, একটা প্রকৃতি প্রদত্ত উপহার বাংলাদেশের জন্য। প্রথম যখন দলে আসেন প্রচণ্ড গতি ছিল তার বলে। সম্ভবত মাশরাফিই বাংলাদেশে পেস বোলিংয়ের একটা স্ট্যান্ডার্ড বা ক্রেজ তৈরি করেছিলেন, যার ফলে তাকে দেখেই কিশোররা পেসার হতে চেয়েছে। অবশ্যই মাশরাফির আগেও আমাদের দেশে ভালো মানের পেসার ছিলেন, যেমন- হাসিবুল হোসেন শান্ত, আনিসুর রহমান, সাইফুল ইসলাম, জিএম নওশের প্রিন্স, জাহাঙ্গীর আলম দুলু প্রমুখ। তবে সে-সময় ক্রিকেটের ওপর এত আগ্রহ ছিল না মানুষের। শুধু পারফরমার কিংবা নেতা হিসেবে নয় আজকে ১৮ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার, কোনোদিন ডিসিপ্লিন ভাঙার অভিযোগ উঠে নাই, একটা বিতর্ক হয়নি তাকে নিয়ে। 

মাশরাফির তুলনা কেবল মাশরাফি নিজেই। প্রতিবার মাঠে নামার সময় মাঠের ভেতর ডান পা আগে দিয়ে মাটিতে সালাম করে আকাশের দিকে তাকিয়ে যখন ব্যাটিংয়ে নামেন, অন্যরকম এক আবেগ ছুঁয়ে যায় সবাইকে। তার বক্তব্য, ক্রিকেট রুটি-রুজি, তাই সালাম করি মাঠ, আর আকাশের দিকে তাকাই আল্লাহর নাম নিয়ে তাকে স্মরণ করি। 
ভারতের বিতর্কিত ক্রিকেট টুর্নামেন্ট (আইসিএল) থেকে লোভনীয় প্রস্তাব পেয়েও ফিরিয়ে দেন মাশরাফি। বিপিএল চলাকালে বাজিকরদের কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে মাশরাফি জানিয়ে দেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে। কেন দিবেন না? লাল সবুজের জার্সি যার স্বপ্ন তাকে হাত করা, তাও টাকার বিনিময়ে, এই কাজতো হবার নয়।

দেশের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। দেশের ক্রিকেটের জন্য তার আত্মত্যাগ অনস্বীকার্য। যে মানুষটা পঙ্গু হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে খেলে যাচ্ছেন দেশের জন্য। তাকে নিয়ে সমালোচনা প্লিজ একটু থামান।মানবজমিন 

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে