মঙ্গলবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৩:২০:৩১

ছড়ি ঘুরিয়ে শাসন করেছেন ক্রিকেটবিশ্ব

ছড়ি ঘুরিয়ে শাসন করেছেন ক্রিকেটবিশ্ব

গৌতম ভট্টাচার্য : রোববার সন্ধ্যার ইন্টারন্যাশনাল কল-এ অভিষেক ডালমিয়া বলছিলেন, ‘‘বাবা এখন অনেক ভাল আছেন। দুটো স্টেন্ট বসেছে। আগামী দু-তিন দিনে বাড়ি নিয়ে যেতে পারব। তবে ডাক্তার যা বলবে, সতর্কতা হিসেবে তার চেয়ে হয়তো আমরা চব্বিশ ঘণ্টা বেশিই রেখে দেব।’’ অনেক টেনশনহীন শোনাচ্ছিল অভিষেকের গলা। ‘‘বাবাকে পুরোটা বলিনি। সুস্থ হলে বলব, কী হয়েছিল।’’

ডালমিয়া-পুত্রের সঙ্গে কথোপকথন ব্রেকফাস্ট লাউঞ্জে বসা দিলীপ বেঙ্গসরকরকে জানানো মাত্র তিনি লাফিয়ে উঠলেন। ‘‘তার মানে বাইপাস দরকার হচ্ছে না। উনি বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরের টার্মটাও চালাতে পারবেন।’’ একটু দূরে অজিত ওয়াড়েকর। সস্ত্রীক লাঞ্চে বেরোচ্ছেন। রাতে তার একাত্তরের সোনার টিমকে নিয়ে এখানকার সান মারিনো ক্লাবে অনুষ্ঠান। ওয়াড়েকরও হার্টের রোগী। ডালমিয়ার কুশল জিজ্ঞেস করে বললেন, ‘‘জগুদা হলেন ক্রিকেট প্রশাসকদের গাভাস্কার। এত সহজে ওকে আউট করা যাবে না।’’

পরের ২০ মিনিটের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রয় শহরে হিল্টন এমব্যাসি স্যুইটসের লাউঞ্জের ভিডিও তোলা হলে মনে হতো, ওটাও বুঝি ছোট কেওড়াতলা! একটা সময় প্রচার করা হতো, ডালমিয়া হলেন ক্রিকেটারদের শত্রু। সেটা আশির দশকের শেষ দিক। ডালমিয়া নিজেও সেটা জানতেন বলে নিরন্তর প্রমাণের চেষ্টা করেছেন, তিনি হলেন ক্রিকেটারদের কর্মকর্তা, কর্মকর্তাদের কর্মকর্তা নন। এ দিন লাউঞ্জে আট প্রাক্তন ক্রিকেটারের মুহ্যমান ছবিটা যদি ৭৫-এ ইনিংস শেষ করা ডালমিয়া দেখতেন, তা হলে হয়তো শান্তি পেতেন এই যুদ্ধটাও জিতেছেন বলে।

ওয়াড়েকর বলছিলেন, ভারতীয় ক্রিকেট প্রশাসকদের গাওস্কর! একই সঙ্গে গাওস্কর ও কপিলদেব বললেও হয়তো বাড়িয়ে বলা হতো না। স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতীয় ক্রিকেটে এই রকম বিস্তৃত প্রভাব জীবিত বা মৃত কোনও কর্মকর্তার নেই। মাঝে নির্বাসনের ক’বছর বাদ দিলে ভারতীয় ক্রিকেটের একচ্ছত্র মুকুট রাখা থাকত ডালমিয়ার আলিপুরের বাড়িতে। দশ নম্বর আলিপুর রোডকে বলা হতো ভারতীয় ক্রিকেটের দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট। ক্রিকেটারদের মধ্যে গাওস্কর ও প্রশাসকদের মধ্যে তিনি— এই যুগলবন্দি তিন দশক রাজ করে গিয়েছে।

সিএবি-র দোতলায় বাঁ দিকে কোনার যে ঘরে তিনি বসতেন, ওটা পরবর্তী কালে ক্রিকেট-রসিকের অদৃশ্য সংগ্রহশালা হওয়া উচিত। ওই ঘরটা থেকেই যে বিশ্ব ক্রিকেট নিয়ন্ত্রণ করেছেন অনায়াসে। ফেসবুক-টুইটার-ল্যাপটপের পৃথিবী অচেনা ছিল তাঁর কাছে। বরং আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে কিছু ডালমিয়া জোক রয়েছে ময়দানে। এবং এখানেই হয়তো তাঁর নৈপুণ্য। তিনি রাজ করেছেন এমন ক্রিকেট পৃথিবীতে, যা ইন্টারনেট-পূর্ব। ঘরের কোনায় ওই ফোনটা— নম্বরটা যত দূর মনে পড়ছে ২২৪৮-১১৪৪। সেই টেলিফোন থেকেই আবর্তিত হয়েছে গোটা বিশ্ব ক্রিকেট। ওই ফোন ঘোরানো ম্যান ম্যানেজমেন্টের নৈপুণ্যেই বলতে গেলে আইসিসি প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নির্বাসন ওঠার পর দক্ষিণ আফ্রিকাকে প্রথম ইডেনে খেলিয়েছেন। সম্ভাবনার কঠিনত্ব বিচারে যা পেলে-র কসমস টিম নিয়ে ইডেনে নামার আগে থাকবে।

জীবনে কখনও ডেল কার্নেগি পড়েননি। ‘হাউ টু উইন ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স পিপ্‌ল’ নামটা জানার প্রশ্নই  নেই। কিন্তু যে কোনও লোককে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেওয়ার অসম্ভব ক্ষমতা ছিল। নীতি আর বুদ্ধিতে অসাধারণ। গাওস্কর শোকগাথায় ঠিকই বলেছেন, ‘‘প্রচুর কঠিন পরিস্থিতি তিনি সামলেছেন। যাকে ক্রিকেটের ভাষায় বলে ব্যাড উইকেট সিচুয়েশন।’’

তিনি আর এক কালের বন্ধু বিন্দ্রা বিদেশি স্যাটেলাইট টিভিকে ক্রিকেটে এনেছেন দুরদর্শনকে বাতিল করে। সবচেয়ে বড় কীর্তি লর্ডসে বসে সাহেবদের উপর ছড়ি ঘুরিয়েছেন। তখন বিন্দ্রা পাশে নেই তিনি একা। ব্রিটিশ প্রেস যা ইচ্ছে তাই লিখেছে। পরোয়াই করেননি। বরঞ্চ বিশ্ব ক্রিকেটে শ্বেতাঙ্গ দেশদের করে দিয়েছেন অপাংক্তেয়। যে মডেল আজও সফল ভাবে ব্যবহার করে যাচ্ছেন শ্রীনিবাসনরা।

ডালমিয়াই সম্ভবত একমাত্র ক্রিকেট শাসক যিনি কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে লড়ে কোর্টে জিতেছেন। আর তার চেয়েও বড় কৃতিত্ব কলকাতাকে তুলে এনেছেন বিশ্ব ক্রিকেট মানচিত্রে। স্রেফ একক চেষ্টায়। ইডেনে বিশ্বকাপ ফাইনাল থেকে শুরু করে বড় বড় সব ম্যাচ এনেছেন। আগামী এপ্রিলে টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালও তো তাঁরই আনা।

বাঙালি ক্রিকেট রসিকের কাছে সবচেয়ে আকর্ষনীয় সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে দিয়েছেন ভারতীয় অধিনায়ক হিসেবে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা। এমনই বজ্রআঁটুনি ছিল সেই নিরাপত্তা যে সৌরভের সমালোচকেরা বলতেন, ওকে ঘাঁটানো যাবে না। কিছু হলেই তো গাঙ্গুলি ০৩৩ ডায়াল করবে। অর্থাৎ কলকাতার কোড। আরও পরিস্কার ভাবে বলা ভাল ডালমিয়া না থাকলে ভারতীয় ক্রিকেট বেহালাবাসী  সর্বকালের সেরা অধিনায়ককে পেতই না।

একই সঙ্গে রাজ্য, জাতীয়  ও আন্তর্জাতিক তিন রকম ক্রিকেট মানচিত্রে এমন দাপট ভারতীয় ক্রিকেট কখনও দেখেনি। নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন একমাত্র নমুনা। কিন্তু তিনি বিতর্কে বিতর্কে এখন বেশি কলঙ্কিত।

ডালমিয়া বিশ্লেষকদের অবশ্য পরবর্তীকালে মনে হতে পারে তিনি ক্ষমতায় থাকতে যত উৎসাহী ছিলেন আদর্শগত যুদ্ধে সওয়ার হতে ততটা ছিলেন না। ক্রিকেট প্রশাসনে তার গুরু বিশ্বনাথ দত্তও বরাবর বিশ্বাস করে এসেছেন কর্মকর্তাকেও প্লেয়ারের মতো টপ ফর্মে সরে যেতে হয়। অশীতিপর বিশুবাবু সরে যান সেই কবে— আজ থেকে ২৬ বছর আগে। ডালমিয়া এই দর্শনে বিশ্বাসের কারণই দেখেননি।

২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে