বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৩, ০৭:৫৯:০৮

বাশার-রাসেলসহ বাংলাদেশের স্মৃতিতে জীবন্ত রানা

বাশার-রাসেলসহ বাংলাদেশের স্মৃতিতে জীবন্ত রানা

সাকিব শাওন: জীবন ক্ষণস্থায়ী। যে কাউকেই যেকোনো সময় ছাড়তে হতে পারে পৃথিবী। তবে ক্রিকেটার মানজারুল ইসলাম রানা কি একটু আগেভাগেই বিদায় নিলেন এই ধরণী থেকে। অনেকের মনেই প্রশ্নটা আজ এত বছর পরও উঁকি দিচ্ছে। তা না হলে কেন মাত্র ২২ বছর ৩১৬ দিন বয়সে পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে! রানার বিদায়ে কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন ভিনদেশি কোচ ডেভ হোয়াইটমোরও। তাইতো বাংলাদেশে আসলেই ছুটে যান রানার শহর খুলনায়। হোয়াইটমোর হয়তো রানাকে আজও খুঁজে ফেরেন। ছুটে যান রানার মাকে শান্তনা দিতে। অবশ্য টাইগার অলরাউন্ডার রানা প্রিয় শিষ্যই ছিলেন হোয়াইটমোরের কাছে।

দারুণ এক সম্ভাবনা নিয়ে টাইগার ক্রিকেটে আবির্ভাব ঘটেছিল খুলনার এই ক্রিকেটারের। তবে সেটার বিস্তার বহুদূর আর হল কোথায়। লোকে বলে সবাইকেই নাকি একদিন থামতে হয়, তবে ক্রিকেটার রানা একটু আগেই থামলেন। যখন টাইগার ক্রিকেটে তার দেওয়ার বাকি ছিল আরো অনেক কিছু। ঠিক তখনই নিভে গেল জীবনপ্রদীপ। জ্বলতে জ্বলতে নিভে যাওয়া তারাদের একজন এই রানা।

২০০৭ সালের ১৬ মার্চ রানার প্রয়াণে অবশ্য তার কাছের দুই বন্ধু মাশরাফি বিন মুর্তজা এবং সৈয়দ রাসেল, যাদের কেউই পারেননি রানাকে শেষ দেখা দেখতে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের পোর্ট অব স্পেনে বসে শুধুই ফেলেছিলেন চোখের পানি। কেননা বিশ্বকাপ খেলতে বাংলাদেশ দল তখন ছিল দেশের বাইরে। রানার মৃত্যর খবর বাংলাদেশ দলকে প্রথম জানিয়েছিলেন তখনকার তরুণ ওপেনার তামিম ইকবাল।

অবশ্য তামিমকে এই বিষাদের খবরটি দিয়েছিলেন রানার আরেক সতীর্থ এবং তামিমের বড় ভাই নাফিস ইকবাল। তামিম যখন দলকে এমন খবর জানালেন হোটেলের করিডোরে কান্নাকাটির রোল পড়ে গিয়েছিল। মাশরাফি শুধু বলেছিলেন, 'রানা তুই এটা কি করলি।' পরদিন ১৭ মার্চ রানার কথা মাথায় রেখে দাঁতে দাঁত চেপে ভারতের বিপক্ষে খেলতে নামে বাংলাদেশ দল।

এরপর বাকিটা তো ইতিহাস। সৌরভ গাঙ্গুলী-শচীন টেন্ডুলকারের দলকে ৫ উইকেটে হারিয়ে দেয় টাইগাররা। রানার কথা বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা এখনো মনে রেখেছে। অনেক সময় গণমাধ্যমে অনেক কথাই বলেন তার সতীর্থরা। ২০২০ সালের একটি লাইভে মাশরাফি রানাকে নিয়ে বলেন, '

আমিতো ওর রুমমেট ছিলাম, রানা, নাফিস আর আমি একসঙ্গে খেতে যেতাম। ওর একটা অভ্যাস ছিল, আলোতে ঘুমাতে পারতো না। আর আমি বাতি নেভালে ঘুমাতে পারতাম না। ফলে আমি যতক্ষণ পর্যন্ত না ঘুমাতাম ও জেগে থাকতো। আমি ঘুমিয়ে গেলে ও (রানা) রুম অন্ধকার করে ঘুমাতো।’

রানার বিদায়ের সময়ে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক ছিলেন হাবিবুল বাশার সুমন। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে সেই বিষাদময় দিনের কথা ভুলে যেতে চান বলে জানালেন বাংলাদেশ দলের বর্তমান এই নির্বাচক। 

'এটা নিয়ে অনেকবার প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি । আর মনে করতে চাই না। কেননা এই দিনটি আমাদের জন্যই অনেক কষ্টের একটি দিন। ভুলে যেতে পারলেই খুবই ভালো হত। কিন্তু সে সুযোগ নেই। শুধু আমি বলব এই দিনটি অত্যন্ত কষ্টের একটি দিন। বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্যও অনেক কষ্টের একটি দিন। রানার কাছ থেকে বাংলাদেশের অনেক কিছু পাওয়ার ছিল।'

এদিকে, রানার কাছের বন্ধু জাতীয় দলের সাবেক পেসার সৈয়দ রাসেল ঢাকা পোস্টকে জানালেন তাদের মজার স্মৃতির কথা। রাসেল বলছিলেন, 'সে সময় আমরা বিশ্বকাপ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছিলাম। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের আগের দিন ঘটে যায় এই ঘটনা। রানা থাকবে না এটা আমরা কখনো ভাবতেও পারিনি, কল্পনাও করিনি। কোনো ক্রিকেট খেলোয়াড় এভাবে চলে গেছে এটা জানা ছিল না। দলের জন্য অনেক বড় শকিং বলতে পারেন। আমরা হোটেলের করিডোরে বসে খুব কেঁদেছিলাম। বলা যায় সেই শোক পরের দিনের ম্যাচে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিল।'

ভারতের বিপক্ষে ১৭ মার্চ মাঠে নামার আগে পোর্ট অব স্পেনে নিরবতা পালন করেছিল বাংলাদেশ দল। সেটা মনে করেই রাসেল বললেন, 'রানার জন্য মাঠে নামার আগে আমরা ১ মিনিট নিরবতা পালন করেছিলাম। ওই সময় সবার ভেতরেই একটা হৃদয়বিদারক অবস্থা তৈরী হয়েছিল। বিশেষ করে আমার এবং মাশরাফির ও তো আমাদেরই বন্ধু ছিল।

রানার কোন জিনিসটা এখনো মনে পড়ে জানতে চাইলে রাসেলের অকপট জবাব, 'রানার কথা চিন্তা করলেই তার স্পষ্ট মুখটাই ভেসে ওঠে। ওর বাসে ওঠার দৃশ্য দেখতে পাই। সঙ্গে একটা ব্যাগ থাকত ওর সবসময় অনুশীলন কাপড়ের। ও সবসময় লেট করে উঠত বাসে কিন্তু ধরেন ১০ বা ১৫ সেকেন্ড তার জন্য আমরা ওয়েট করতাম যে ওরে ফাইন দেওয়াব। কিন্তু কোনদিন দিতে পারিনি। আবার ও সবসময় সবাইকে দেরি করিয়েই বাসে উঠত। এগুলো এখনো চোখে ভাসে মনে হয় রানা আছে।'

রানার প্রতিভা নিয়ে রাসেল বলেন, 'আসলে তখনকার সময়ে তার মত অলরাউন্ডার তো ছিল না। সাকিব তখন আসেনি। তার আগে সলিড বোলিং করত রানা থ্রিলিং ব্যাটিং করত। একটা প্যাকেজ ছিল বলা যায়, বিশেষ করে ওয়ানডেতে সে একজন কার্যকর বোলার ছিল। টি-টোয়েন্টি শুরু হয়নি তখনো, যদি রানা খেলার সুযোগ পেত ভালো করত।'

মাশরাফি-রাসেলের মতো রানারও খুব পছন্দ ছিল বাইকে চড়া। আর সেই বাইকই যেন তার কাল হলো। এক বিকেলে অনুশীলন শেষে খুলনা থেকে বাইকে চড়ে চুকনগরের বিখ্যাত আব্বাস হোটেলে চুইঝালের মাংস খেতে আসছিলেন রানা। তবে বাইকটি খুলনার বালিয়াখালি ব্রিজের কাছে আসতেই বিপরীত দিক থেকে আসা এক অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান রানা। সঙ্গে থাকা আরেক ক্রিকেটার সেতুকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনিও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

সেই বিখ্যাত আব্বাস হোটেল এখনো চলছে সেই আগের দাপটে। কত মানুষ খেতে আসে, কত মানুষ খেয়ে যায় শুধু আসেন না রানা। আর কখনোই যে তিনি আসবেন না। রানা যে ক্ষণজন্মা এক ক্রিকেটার। রানার কথা স্মরণ রেখেই তার নামে খুলনার শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামের একটি স্ট্যান্ডের নাম বদল করে রাখা হয়েছে ‘মানজারুল ইসলাম রানা স্ট্যান্ড’।

যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে আজ হয়তো রানা সেখানেই খেলতেন অথবা ক্রিকেটারদের করাতেন কোচিং। ওপর থেকে হয়তো স্টেডিয়ামে নিজের নামে খোদাই করা স্ট্যান্ডের দিকে তাকিয়ে রানা সেসব ঠিকই দেখছেন। রানা হারাচ্ছেন না, রানা থাকছেন মাশরাফির ধরে দিবানির মধ্যে কিংবা রানা থাকছেন টাইগারদের উল্লাসের মধ্যে দিয়ে।-ঢাকা পোস্ট

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে