আন্তর্জাতিক ডেস্ক: দুজন খ্যাপাটে রাষ্ট্রপ্রধান এখন পুরো বিশ্বকে তটস্থ করে রেখেছেন। একজন একঘরে হয়ে থাকা দেশ উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং-উন, আর অপরজন পুঁজিবাদী বিশ্বের নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প।
প্রথমজনকে নিয়ে ভয়, তিনি কখন না যুদ্ধ শুরু করে দেন। কিন্তু দ্বিতীয়জন? তিনি তো ইতিমধ্যেই আমার-আপনার সবার জীবনে নানা ধরনের উৎপাত শুরু করে দিয়েছেন! কোনো সরকারেরই প্রথম ১০০ দিন তার কাজের মূল্যায়নের জন্য যথেষ্ট নয়।
কিন্তু যাত্রার সূচনায় ইঙ্গিত মেলে বাকি পথটা কেমন কাটবে? দুর্ভাগ্যজনক হলেও মানতে হবে যে আমরা তাঁকে নির্বাচিত না করলেও তাঁর খ্যাপাটেপনার খেসারত আমাদের সবাইকেই দিতে হবে।
অভিষেকের পর মি. ট্রাম্পের জারি করা নির্বাহী আদেশগুলোর কথা মনে করুন। প্রথম দিন তিনি দুটি নির্বাহী আদেশে সই করেন—একটিতে তিনি বাতিল করেন তাঁর পূর্বসূরি বারাক ওবামার প্রণীত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা; আর অপরটিতে যেসব আইন কার্যকর হওয়ার অপেক্ষায় ছিল, সেগুলো তাঁর প্রশাসন পর্যালোচনা না করা পর্যন্ত স্থগিত রাখা। এগুলো মোটামুটি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
কিন্তু দুদিন পর তিনি যে আদেশটি সই করলেন, তাতে বন্ধ হয়ে গেল সারা বিশ্বে নারীর জন্মনিয়ন্ত্রণ ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমে অর্থায়ন। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল ইউএনএফপিএ এক বিবৃতিতে বলেছে যে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নের কারণে তারা বিশ্বে হাজার হাজার প্রসূতি ও শিশুমৃত্যু রোধ করতে পেরেছে; যার মনে দাঁড়ায়, এখন এই অর্থায়ন বন্ধের কারণে এ রকম অনেক মৃত্যু ঠেকানো যাবে না।
অবশ্য রক্ষণশীল রিপাবলিকানরা ক্ষমতায় এলে এমনটিই হয়ে থাকে। ওই দিনই তিনি ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ ট্রিটি (টিপিপি) থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্তে সেই করেন। টিপিপিতে বাংলাদেশের মতো অনেকের ক্ষতির আশঙ্কা ছিল বলে হয়তো কিছুটা সন্তুষ্টির সুযোগ ছিল। কিন্তু সেটা উবে যায় সব দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে বাণিজ্য চুক্তি করার জন্য তাঁর অঙ্গীকার এবং আমেরিকা ফার্স্ট নীতিতে।
সবার আগে আমেরিকার লাভ নিশ্চিত করার নীতিতে কোনো ন্যায্যতার অবকাশ নেই, নেই কোনো মানবিকতা। বস্তুত, এরই ধারাবাহিকতায় শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি টোয়েন্টি এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এই প্রথমবারের মতো বাণিজ্যে সংরক্ষণবাদবিরোধী অঙ্গীকারের কথা বাদ দিতে বাধ্য হয়েছে। অতএব, বলতেই হবে, বাণিজ্য উদারীকরণের কারণে আমরা এত দিন যে সমৃদ্ধির আলো দেখেছি, তার আয়ু হয়তো আর বেশি দিন নেই।
এরপরের আদেশগুলোর কয়েকটি আমাদের জন্য আরও মারাত্মক—এক অর্থে প্রাণঘাতী। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমনকারী জ্বালানি ব্যবহার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে তাঁর পূর্বসূরির নেওয়া পদক্ষেপগুলো একে একে নাকচ করতে শুরু করেন।
তেল পরিবহনের জন্য কানাডার আলবার্টা থেকে নেব্রাস্কার স্টিল সিটি পর্যন্ত এবং ওহাইওর সংরক্ষিত অঞ্চলের মধ্য দিয়ে দুটো বিতর্কিত পাইপলাইন নির্মাণের প্রকল্প পুনরুজ্জীবনের জন্য তা পর্যালোচনার আদেশ দেন। যেসব বড় অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প পরিবেশগত সমীক্ষার কারণে আটকে ছিল, সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন।
তিনি পরিবেশগত আইনকানুন বাস্তবায়নকারী সংস্থা এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সির (ইপিএ) বরাদ্দ এত বড় আকারে বাতিল করে দিয়েছেন যে তার পক্ষে পরিবেশগত খবরদারির কাজ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। আর এই সর্বনাশা পদক্ষেপগুলো যাতে তিনি অবাধে নিতে পারেন, সে কারণে প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা ঘোষণা করবেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
এগুলোর ফলাফল দাঁড়াবে—যুক্তরাষ্ট্র আবারও বিশ্বের প্রধান দূষণকারী দেশে পরিণত হবে। প্যারিস চুক্তিতে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার এই শতাব্দীর শেষে ২ ডিগ্রির মধ্যে ধরে রাখার যে লক্ষ্যে সবাই সম্মত হয়েছে, তা বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে। ফলে বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর পানিতে তলিয়ে যাওয়ার গতি দ্রুততর হবে।
বরিশালের জাকির হোসেনের কথা হয়তো আমরা অনেকেই শুনিনি। ৪৫ বছর বয়সী এই বাংলাদেশির ২০১৯ সাল পর্যন্ত বৈধ ভিসা থাকার পরও শিকাগো বিমানবন্দর থেকে গত ২৮ মার্চ তাঁকে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশ থেকে আসা বিমানে ল্যাপটপ বহনে নিষেধাজ্ঞা জারি হয় তার দুদিন আগে। ফলে হাজার হাজার যাত্রীর দুর্ভোগের খবরে জাকিরের হয়রানি চাপা পড়ে গিয়েছিল। এর আগের কয়েক সপ্তাহ ধরে অবশ্য বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে ছিল মুসলিম নিষেধাজ্ঞা (ব্যান) পরিচিত সাতটি (পরে ছয়) মুসলিম দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা। তিনি প্রথম আদেশটি জারি করেছিলেন ২৭ জানুয়ারি।
কিন্তু আদালত তা স্থগিত করে দিয়েছিল। পরে তিনি সংশোধিত নিষেধাজ্ঞা জারি করেন ৬ মার্চ। কিন্তু এই দ্বিতীয় আদেশও আদালতে স্থগিত হয়ে গেছে। এ কারণে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মুসলিম পরিচয়ের পাসপোর্টধারীদের জন্য একধরনের বিশেষ অবস্থান (বৈষম্যের) ইতিমধ্যেই নিশ্চিত করেছেন।
আমরা অনেক সময়েই রাষ্ট্রীয় বিষয়ে নির্বাচিত রাজনীতিকদের পরিবারের ভূমিকা নিয়ে অস্বস্তি প্রকাশ করে থাকি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার আমলে তাঁর ছেলের পরিচালনাধীন হাওয়া ভবন তো রীতিমতো একটি মিথে রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট ফ্যামিলিকে দেখে এখন তো সবার আক্কেলগুড়ুম অবস্থা! তাঁর মেয়ে ইভানকা তাঁর বিশেষ সহকারী এবং হোয়াইট হাউসে তাঁর জন্য আলাদা দপ্তর এবং আলাদা চিফ অব স্টাফের ব্যবস্থা হয়েছে।
ইভানকার স্বামী জেরার্ড কুশনার প্রেসিডেন্টের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা। কার্যত তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর চেয়েও তিনি বেশি ক্ষমতাধর। কাগজে-কলমে না হলেও বাস্তবে। ইভানকার ফ্যাশনসামগ্রী এখন বিশ্বজুড়েই সরকারগুলোর কাছে বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে।
চীনা প্রেসিডেন্টের সফরের আগে চীনে ইভানকার যতগুলো ব্র্যান্ডের ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়েছে, তা একটা নতুন রেকর্ডের জন্ম দিয়েছে। ট্রাম্প মহোদয়ের নিজস্ব অবকাশকেন্দ্র এবং গলফ ক্লাবে এখন লাখ ডলারের সদস্যপদ নেওয়ার হিড়িক পড়েছে। সুতরাং, ধারণা করি, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালকে এখন নতুন করে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং স্বার্থের দ্বন্দ্বের সংজ্ঞায়ন করতে হবে।
সবশেষে, ব্যক্তি ট্রাম্পের মানসিক অবস্থার যে পরিচয় তিনি দিয়েছেন, সেটির কথা বলি। আসাদের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে শিশু-নারীসহ বেসামরিক নাগরিকদের হত্যার খবরে মি. ট্রাম্প আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন বলে টিভি পর্দায় হাজির হয়ে আমাদের জানিয়েছেন। আবেগাপ্লুত হওয়ারই বিষয়, সন্দেহ নেই। প্রতিক্রিয়ায় তিনি সিরিয়ায় ৫৯টি টমা হক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
সে সময়ে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং তাঁর অতিথি হিসেবে ফ্লোরিডায় ম্যারি ও লাগা অবকাশকেন্দ্রে ছিলেন। তাঁরা সেখানে নৈশভোজের শেষ পর্বে যখন অতীব সুস্বাদু চকলেট কেক খাচ্ছিলেন, তখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর অতিথিকে বললেন, ‘ও হ্যাঁ, আপনাকে জানানো দরকার, আমি সিরিয়ায় ৫৯টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছি।’ ভেবে দেখুন, এই ব্যক্তির হাতেই আছে বিশ্বকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য যথেষ্টসংখ্যক পরমাণু অস্ত্রের চাবি (কোড)।
এমটিনিউজ২৪ডটকম/এম.জে