সোমবার, ০৩ এপ্রিল, ২০১৭, ০১:০৭:২৯

নজর কাড়া সুন্দর বাড়িটি এখন ‘অভিশপ্ত’

নজর কাড়া সুন্দর বাড়িটি এখন ‘অভিশপ্ত’

মাসুদ আহমদ : মৌলভীবাজার শহরের বড়হাটে জঙ্গি আস্তানায় ‘অপারেশন ম্যাক্সিমাস’ শেষ হওয়ার পর মৌলভীবাজারে স্বস্তি ফিরে এসেছে। অপারেশনস্থলের  আশেপাশে এখনো পুলিশ পাহারা বহাল আছে। তবে জঙ্গি আস্তানা নির্মূলের সংবাদ শোনার পরপর মানুষ বাসার বাইরে আসার সুযোগ পাচ্ছেন।

গতকাল সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে জঙ্গি আস্তানার সেই বাড়িটি এখনো পুলিশ ঘিরে রেখেছে। বাড়ির আশেপাশে কাউকে ঘেঁষতে দিচ্ছে না। ১৪৪ ধারা জারি আছে। তবে  এলাকার পরিধি কমিয়ে আনা হয়েছে। তবে লোকজনদের সঙ্গে আলাপ করে দেখা গেছে, বড়হাট এলাকার মধ্যে যে বাড়িটি সবার নজর কাড়তো সেই বাড়িটি এখন এলাকাবাসীর কাছে ‘অভিশপ্ত’ বাড়ি হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠছে।

এদিকে গতকাল পৌরসভার পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয়েছে শহরে। সতর্ক করে বাড়িওয়ালাদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে বাসায় ভাড়াটিয়া সম্পর্কে সঠিকভাবে খোঁজখবর নিতে এবং জঙ্গি কার্যকলাপে জড়িত কিনা সেই বিষয়টি খেয়াল রাখতে এবং তথ্য জানাতে।

২৮শে মার্চ গভীর রাতে মৌলভীবাজার পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ডের বড়হাট এলাকায় জঙ্গি আস্তানা চিহ্নিত হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঐ আস্তানা ঘিরে ফেলে এবং এলাকার আশেপাশে লোক চলাচল কমিয়ে দেয়। মোড়ে মোড়ে পুলিশ, র‌্যাবসহ বিভিন্ন সংস্থার লোকজন অবস্থান নেয়। ঘন ঘন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এলাকা পরিদর্শনে যান। এরপর বুধবার দুপুর ২টা থেকে এই ওয়ার্ডে জেলা প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। তারপর থেকে কার্যত এই ওয়ার্ডের বাসিন্দারা বাসায় বন্দি হয়ে পড়েন।

মাইকে জনসাধারণকে অবহিত করা হয় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাসার বাইরে কেউ না আসতে। কেউ আসলেও জেরার মুখে পড়তে হয়। প্রকাশ হয় চিহ্নিত জঙ্গি আস্তানায় বড় মাপের কোনো জঙ্গি আছে। এর প্রভাব পড়ে সারা শহরে। স্কুল-কলেজে ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতি কমে যায়। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয় নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এর প্রভাব পড়ে। এরমধ্যে সদর উপজেলার নাসিরপুরে আরেক জঙ্গি আস্তানায় কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের ‘সোয়াত  অভিযান ‘হিট ব্যাক’ পরিচালনা করে।

সেই অভিযানের সংবাদ শেষ হতে না হতেই বড়হাটে অভিযানের জন্য প্রস্তুতি শুরু হয়। শুক্রবার এই অভিযানের নাম দেয়া হয় অপারেশন ম্যাক্সিমাস। তখন শহরের মানুষ সোয়াতের অপারেশন বুঝতে পারেন গুলি ও বোমার শব্দ শুনে। তাই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সারা শহরে। ঢাকা-সিলেট সড়কের মৌলভীবাজার শহরের অংশে যান চলাচল কমিয়ে দেয়া হয়। অপারেশন শেষে শনিবার দুপুর ১২টায়  কর্মকর্তারা প্রেস ব্রিফিং করে জঙ্গিমুক্ত এবং মৌলভীবাজারে আর কোনো আস্তানা নেই বলার পরই শহরের মানুষ বাসার বাইরে চলে আসে।

এই সময় বড়হাট এলাকার  ছায়া ভিলার মো. আব্দুল্লাহ (৭০) বলেন- মনে হলো প্রাণ ফিরে পেয়েছি। গতকাল সরজমিন বড়হাট এলাকার বাসিন্দাসহ শহরের অনেকের সঙ্গে কথা হয়। চারদিনের অবরুদ্ধ অবস্থার বর্ণনা দিয়ে কুসুমবাগ এলাকার এক হোটেল ব্যবসায়ী বলেন- এই সময় শহরে মানুষের উপস্থিতি একেবারে কম ছিল। বেচা-বিক্রি ছিল না। কোনো দিন স্টাফ খরচ তোলা যায়নি। তবে এই ক্ষতি হলেও জঙ্গি নির্মূল হওয়ায় তিনি খুশি।

আরেক ব্যবসায়ী সেলিম আহমদ (৩৫) বলেন- এমন স্থানে জঙ্গি আস্তানা গড়ে উঠলো কিভাবে। কেউ বুঝতেই পারলো না। তাই আমরা আতঙ্কে আছি। বড়হাটের রাজা কমপ্লেক্সের বাসিন্দা শাহিন (২৫) বলেন- এই বাসা খুব সুন্দর। এই বাসায় এই জঙ্গিরা থাকতো তা ভাবাই যায় না। তাই এই বাসা আজ থেকে সবার কাছে একটি অভিশপ্ত বাড়ি হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

কুসুমবাগ এলাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ফয়ছল আহমদ গতকাল বলেন, মানুষের ভয় এখনো কাটেনি। তাই মানুষ কম আসছে শহরে। এই বাসার পাশেই মৌলভীবাজার পৌরসভার জনপ্রিয় মেয়র ও জেলা যুবলীগের সভাপতি মো. ফজলুর রহমানের বাসা। জঙ্গি আস্তানার সংবাদ জানার পর থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে তাকেও তৎপর দেখা গেছে।

গতকাল এক প্রতিক্রিয়ায় মেয়র ফজলুর রহমান বলেন, ঘাঁটি হয়তো ধ্বংস হয়েছে। জঙ্গিরা মারা গেছে কিন্তু আমাদের গায়ে কালিমা লাগিয়ে দিলো তারা। তাই সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে আশপাশে কারা থাকে তাদের চলাফেরা কেমন। সন্দেহজনক হলেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা দরকার। তিনি বলেন- আমার বাসার পাশেই এমন সুন্দর একটি বাড়িতে জঙ্গি আস্তানা ভাবতেই কষ্ট হয়।

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়নের মৃত আছদ্দর মিয়ার ছেলে সাইফুর রহমান থাকেন বৃটেনে। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। প্রবাসী বাবার সুবাদেই তিনি প্রবাসী। গ্রামের বাড়িটিও সুন্দর। মৌলভীবাজার শহরের বড়হাট এলাকায় খুব শখ করে একটি ডুপ্লেক্স ভবন তৈরি করেছিলেন শ্বশুরালয়ের পাশেই। নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। বাড়ির নির্মাণশৈলী ছিল চমৎকার। দৃষ্টি কাড়ার মতো। বাড়িতে একদিন থাকার সুযোগ হয়নি। কিন্তু এই বাড়িটি এখন এক অভিশপ্ত বাড়ি হিসেবে চিহ্নিত। নিজের কাছে। সবার কাছে।

অপারেশন ম্যাক্সিমাস’-এর কারণে এই বাড়ি এখন আলোচিত। সাইফুর রহমান প্রবাসে থাকলেও নবীগঞ্জ উপজেলার জনৈক জুয়েল কেয়ার টেকারের দায়িত্ব পালন করতো। এই জুয়েলের নিকট থেকে বেলাল নামে এক ব্যক্তি সাইফুর রহমানের বড়হাটের বাড়ি ৭২০০ টাকা এবং নাসিরপুরের গ্রামের বাড়ি ৬৬০০ টাকায় ভাড়া নেয় একমাসের এডভান্স দিয়ে। এরপর এক মাসের ভাড়া পরিশোধ করে।

আগামী ৫ই এপ্রিল আরেক মাসের টাকা দেয়ার কথা ছিল। জুয়েল সূত্রে জানা যায়, বেলাল পরিবার নিয়ে বড়হাটের বাসায় ছিল। নাসিরপুর বাড়িতে থাকতো মাহফুজ তার স্ত্রী শ্বশুর-শাশুড়ি ও বাচ্চাদের নিয়ে। ২৮শে মার্চ বড়হাটের জঙ্গি আস্তানা শনাক্তের পর আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে জুয়েলই প্রথম জানায়, এখানে অবস্থানকারী ব্যক্তির নিকট আত্মীয়রা থাকেন নাসিরপুরের বাড়িতে। তখনই কর্মকর্তারা প্রথম জানতে পারেন। এমজমিন
০৩ এপ্রিল ২০১৭/এমটি নিউজ২৪/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে