বুধবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৭, ০১:৫৪:৪৪

জনশূন্য গ্রামের পর গ্রাম

জনশূন্য গ্রামের পর গ্রাম

রুদ্র মিজান ও এমএ রউফ : জনশূন্য গ্রামের পর গ্রাম। যমুনার পানিতে ভাসছে ঘর, ঘরের আসবাবপত্র। বন্যার ধকল সামলে উঠতে পারেনি জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার মানুষ। পৌরসভা ও উপজেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামই বন্যাক্রান্ত হয়েছে। পানি কমছে কিন্তু বসতবাড়ি ফিরে পাচ্ছেন না অনেকে। নদীতীরবর্তী গ্রামগুলো জনশূন্য খাঁ খাঁ করছে।

কোনো কোনো গ্রামের অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে প্রায়। বন্যায় ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে যমুনা। বন্যার পর অবশিষ্ট থাকা ভিটেমাটি ভাঙছে যমুনার টেউয়ে। গত দুই সপ্তাহ যাবত বন্যার সঙ্গে সংগ্রাম করে বেঁচে আছেন এই এলাকার মানুষ। রাস্তায়, স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন তারা। আশ্রয় জুটলেও নিয়মিত খাবার জুটছে না।

ক্ষুধায় কান্না করে শিশুরা। ত্রাণের জন্য পথ চেয়ে থাকেন বন্যার্তরা। ত্রাণ দেয়া হয় ঠিকই কিন্তু ভাগ্যে জুটে না সবার। অভিযোগ রয়েছে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতির। যদিও ত্রাণের বিপুল চাহিদার কথা সংশ্লিষ্টরা স্বীকার করে জানিয়েছেন, কিন্তু বারদ্দকৃত ত্রাণ অপ্রতুল।

সরকারি হিসেবে সরিষাবাড়ীর অন্তত ১১০টি গ্রাম বন্যায় ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব গ্রামের মধ্যে অন্যতম পিংনা ইউনিয়নের ডাকাতিয়া মেন্দা, বালিয়া মেন্দা, কবলিবাড়ি, বাসুরিয়া, চরবাসুরিয়া। ডাকাতিয়া মেন্দার শমেসবাড়ি চরে প্রায় ৭০টি পরিবার বসবাস করতো। দুই সপ্তাহ আগেও তারা ভাবতে পারেনি তাদের সর্বস্ব কেড়ে নেবে বন্যা।

শমেসবাড়িচরের বাসিন্দা আব্দুর রহিম জানান, হঠাও বন্যার পানি বাড়তে থাকে। বাড়ির জিনিসপত্র সরানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। এর মধ্যেই পানি ঢুকে যায় ঘরে। এক ঘণ্টার মধ্যেই পানিতে তলিয়ে যায় গ্রামের নিচু অংশ। একপর্যায়ে ঘরগুলো ডুবে যায়। গতকাল সেখানে গিয়ে দেখা গেছে মাটিতে পড়ে আছে ভাঙ্গা ঘরের কাঠ, টিন। কোনো কোনো ঘর মাটিতে ডেবে গেছে। ৭০টি ঘরের মধ্যে মাত্র তিনটি ঘর নড়বড়ে অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।

তার পাশেই ডাকাতিয়া মেন্দা গ্রাম। সেখানে গিয়ে দেখা গেছে গ্রাম ছেড়ে গেছেন অনেকে। কেউ কেউ তখনও ঘরের কাঠ, টিন টেনে টেনে নৌকায় তুলছিলেন। তাদের একজন পিংনা ইউনিয়নের মেম্বার সোহরাব আলী। তিনি বলেন, ৩২ বছর যাবত এহানে বাড়ি-ঘর কইরা আছি। এতবড় বন্যা দেহি নাই। বন্যায় হু হু করে পানি উইঠা পড়ে। আমাগোর ঘরের জিনিসপত্র বাইর করতে পারি নাই। বন্যায় ভাইসা গেছে। তিনি জানান, প্রথম ঘর-দুয়ার ভাসিয়ে নিয়েছে। এখন ভিটেমাটি ভাঙছে যমুনার পানিতে। তাই অনেকের মতো গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছেন তিনি।

এই গ্রামের ঘাটে দাঁড়িয়ে ছিলেন মমিনুল ইসলাম, তোফাজ্জল, আব্দুল হাই, মকবুল হোসেনসহ অনেকে। দূরে কোনো নৌকা দেখলেই ত্রাণের আশায় ঘাটে ভিড় করেন তারা। মকবুল জানান, নিজের ঘর রক্ষা করতে পারেননি। সবকিছু ভেসে গেছে। ছেলে-মেয়ে না খেয়ে ছিল। কেউ কোনো সহযোগিতা করেনি। ঘর হারিয়ে অনেকের মতো তিনিও তারাকান্দি বঙ্গবন্ধু সেতু সড়কে আশ্রয় নিয়েছেন।

মকবুল বলেন, কামলা দিলি খাই। কামলা দিতে না পাইলে উপোস থাকি। ওই সড়কে আশ্রয় নেয়া প্রায় ২৫ জনের সঙ্গে কথা বললে তারা সবাই জানান, তারা কেউ ত্রাণ পাননি। তাদের অভিযোগ, চেয়ারম্যান তার নিজের ও দলের লোক দেখে দেখে ত্রাণ দিচ্ছেন। যে কারণে চরম দুর্ভোগের শিকার হয়েও বঞ্চিত হচ্ছেন তারা।

পিংনা ইউনিয়নের মেম্বার হারুন অর রশীদ বলেন, ঘর-বাড়ি হারিয়ে মানুষ রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছে। তারা খাবার পাচ্ছে না ঠিকমতো। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তাকে কোনো ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হয়নি। যে কারণে ত্রাণ বিতরণ করা সম্ভব হয়নি ইউপি মেম্বার হারুনের। তবে ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোতাহার হোসেন জয় জানিয়েছেন, প্রায় সবাই বন্যার্ত। যে কারণে সবাইকে ত্রাণ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ পর্যন্ত ওই ইউনিয়নে ২০ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

পোগলদিঘা ইউনিয়নের মালিপাড়া, বিন্নাফৈর গ্রামের ইউসুফ আলী, আনিসুর রহমানসহ অনেকে জানান, বন্যা তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন কেড়ে নিয়েছে। বাড়ির পেছনে পানিতে পাটের জাগ ছিল, যা বিক্রি করলে প্রায় লাখ টাকা পেতেন এই কৃষক। বানের জল তা ভাসিয়ে নিয়েছে। নিঃস্ব এই কৃষক পরিবারে এখন ঠিকমতো খাবার জুটছে না। জুটছে না ত্রাণ। পোগলদিঘা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শামস উদ্দিন জানান, এই ইউনিয়নের ৩১টি গ্রামের মধ্যে ২৮টি গ্রাম বন্যাক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু ত্রাণ অপ্রতুল। কোনোভাবেই সবাইকে ত্রাণ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান তিনি।

এদিকে, নতুন করে কোনো কোনো গ্রাম বন্যাকবলিত হচ্ছে। বন্যার পানি ঝিনাইনদীতে নামতে গিয়ে আশপাশের গ্রামগুলো প্লাবিত হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে সরিষাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাঈয়েদ এ জেড মোর্শেদ আলী বলেন, কিছু গ্রামের প্রায় সব ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। আবার নতুন করে কয়েক গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে- সেদিকে আমাদের খেয়াল রয়েছে। যারা ঘর হারিয়েছেন তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। উপজেলায় এ পর্যন্ত ১৮০ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আস্তে আস্তে সব বন্যার্তকে ত্রাণ দেয়া হবে। এমজমিন
এমটিনিউজ/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে