স্পোর্টস ডেস্ক: এ যেন গরীবের ফুটবলে এক চিলতে আলো। রোববারের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্টেডিয়াম সেই আলোয় উদ্ভাসিত। নারীদের কোনো সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৫ দল। বাংলাদেশ গোটা টুর্নামেন্টে ১৩ গোল দিয়ে এক গোলও হজম করেনি! এমন সাফল্য এসেছে লম্বাদেহী কিশোরী ডিফেন্ডার মোসাম্মৎ আঁখি খাতুনের বীরত্বে। মাঠ ছাড়ার সময় বাফুফের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পল স্মলি যাকে তুলনা করলেন বার্সার পিকের সঙ্গে। তিনি যদি এই বাংলার কায়সার হামিদকে চিনতেন, তবে নিশ্চিতভাবে আঁখিকে ‘কায়সার হামিদ’ বলতেন।
এই তুলনা মোটেও অবাস্তব নয়। নয় কাল্পনিকও। যারা গত কয়েকদিনে ঢাকার মাঠে বাংলাদেশের খেলা দেখেছেন, তারা বিষয়টি বুঝতে পারবেন। কমপক্ষে ফাইনাল দেখে থাকলেও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের মেয়ে আঁখির দক্ষতা চোখে পড়ার কথা। প্রত্যেক ম্যাচে বাংলাদেশের রক্ষণ আগলে রাখার সুবাদে নির্বাচিত হয়েছেন টুর্নামেন্টের ‘মোস্ট ভ্যালুয়েবল’ খেলোয়াড়। সেই সঙ্গে দল কর্নার পেলেই আঁখিকে আবিষ্কার করা গেছে প্রতিপক্ষের বক্সে। বার্সার হয়ে ঠিক এই কাজটি করেন জেরার্ড পিকে। এক সময় করতেন বাংলাদেশের দীর্ঘদেহী কায়সার হামিদ।
কোচের কৌশলে আঁখির আলো
বাংলাদেশ কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন এদিন ভারতের বিপক্ষে ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে দল সাজান। মাঝমাঠ আর রক্ষণ সামলে দলগত এই আক্রমণের ফর্মুলাটি ফুটবলে আধুনিক সংযোজন। ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল নাগাদ বিশ্বফুটবলে এই কৌশল জনপ্রিয় হয়।
ডিফেন্সের নেতৃত্বে ছিলেন আঁখি। তার সঙ্গে অন্য তিনজন অ্যানি মোগিনি, নিলুফা ইয়াসমিন নীলা এবং নাজমা। মিডফিল্ডে অধিনায়ক মনিকা চাকমা এবং মারিয়া মান্ডা। তাদের উপরে বাঁ উইংয়ে শামসুন্নাহার, মাঝখানে অর্থাৎ সেন্টার অ্যাটাকিং মিডফিল্ডে ফরওয়ার্ড তহুরা খাতুন, ডান উইংয়ে মার্জিয়া।
ভারতীয় কোচ এদিন বাংলাদেশের মাঝমাঠ দুর্বল করার কৌশল নিয়ে মাঠে নামেন। একজন মাত্র স্ট্রাইকার রাখেন সেন্টার পজিশনে, নিকিতা বিশিকে। পরিকল্পনা ছিল খেলা টাইব্রেকারে নেয়ার। দলটি মার খেয়েছে এখানেই। আঁখি পুরোটা সময় বিশিকে প্যাকেট করে রাখেন। শরীর ঘেঁষা মার্কিংয়ে তাকে নড়তেই দেননি। আঁখির মূল শক্তি তার ডান পা। খেলতে হলে প্রতিপক্ষের সীমানায় বল রেখে খেল-কোচের এমন নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন আঁখি। নিজেদের রক্ষণে বল পেলেই ভারতের সীমানায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। বল তুলে মারার দক্ষতায় আঁখির জুড়ি মেলা ভার। ভিড়ের ভেতর, রানিংয়ের সময়; যেখানে যে অবস্থায় বল পেয়েছেন প্রতিপক্ষের সীমানায় পাস করে দিয়েছেন। ভারতীয় ফরোয়ার্ড নিকিতা অসহায় শিশুর মতো আঁখির কাছে নতজানু হয়েছেন। পাসিং ফুটবলে জায়গা করতে না পেরে ভারত কয়েকবার এরিয়াল শটে নজর দেয়। প্রায় পাঁচ ফিট উচ্চতার আঁখি এখানেও অপ্রতিরোধ্য। কোচ চিৎকার করে নির্দেশ দেয়ার আগেই বাতাসে ভাসা বলে মাথা দিয়েছেন।
উইং প্লেতে নান্দনিক আঁখি
বাঁ উইংয়ে কিশোরীরা যা খেলেছে, তা দেখলে পুরুষদের সিনিয়র দলও লজ্জায় পড়ে যেত। ডিফেন্ডার থেকে উইঙ্গার বনে যাওয়া শামসুন্নাহার ম্যাচের একমাত্র যে গোলটি করেছেন, তা উইং প্লের ফসল। আঁখি বাঁদিকে সমান তালে বল তুলেছেন। সেই বল কখনো পড়েছে মারিয়া মাণ্ডার পায়ে, কখনো নীলার পায়ে। আবার কখনো সরাসরি শামসুন্নাহারের পায়ে। তার সঙ্গে হঠাৎ হঠাৎ যোগ দেন তহুরা। বাংলাদেশ খেলাটা বের করেছে মূলত এই অঞ্চল দিয়ে। প্লেমেকার মারিয়া এবং মনিকা পাসিং ফুটবলে নজর কাড়েন। উইঙ্গার শামসুন্নাহার আগুয়ান বলে বড় শট নিতে আরেকটু দক্ষ হলে বাংলাদেশ গোল পেত আরো কয়েকটি। উইং প্লেতে এত ভালো খেলেও শামসুন্নাহারের ছোট একটি ভুলে বক্সে প্রভাব বিস্তার করতে পারছিল না বাংলাদেশ। সেটি সময় মতো খেয়াল করেন কোচ ছোটন।
গোলাম রব্বানী ছোটন
শামসুন্নাহার বল নিয়ে মাঠ বড় করে কর্নার অঞ্চলের দিক থেকে বারবার বক্সে ঢুকছিলেন। এতে দলের অন্যতম সেরা ফরওয়ার্ড তহুরা বলে যেতে পারছিলেন খুব কম। উইঙ্গার শামসুন্নাহার ৪০ মিনিটের পর মাঝমাঠের একটু উপর থেকে বক্স বরাবর বল নিয়ে ঢোকার চেষ্টা করা শুরু করেন। আর তাতেই আসে সাফল্য। ৪১তম মিনিটে তিনি বল পেয়ে কর্নার অঞ্চলে না যেয়ে দ্রুত তহুরাকে দিয়ে দেন। বল ছেড়েই বক্সের দিকে চলে যান। তহুরা কাট করে তাকে দিয়ে দেন। ততক্ষণে ভারতের বক্সে ভিড় লেগে যায়। সেই ভিড় থেকে আলতো শটে গোল করেন ওই শামসুন্নাহার ।
বাংলাদেশের কায়সার হামিদ ওভারল্যাপিংয়ে ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। আঁখি দলের প্রয়োজনে অতটা ওভারল্যাপ করেন না। কোচের নির্দেশ ছিল ‘নিরাপদ ফুটবল’ খেলার। ম্যাচ শেষে তিনি বলেন, ‘আমার কোচ আমাকে ওভাবেই খেলতে বলেছেন। আমাদের সীমানায় আমি বল রাখতে চাইনি। চেষ্টা করেছি সেভ ফুটবল খেলার।’
ছোটন-পল স্মলির যুগলবন্দী
বাংলাদেশ দলের প্রধান কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন। তাকে সাহায্য করেছেন বাফুফের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর ব্রিটিশ কোচ পল স্মলি। যিনি এক সময় ইংলিশ ক্লাব পোর্টস মাউথের যুব একাডেমির ডিরেক্টর ছিলেন। নিউজিল্যান্ডের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর এবং ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের রিজিওন্যাল ডিরেক্টর হিসেবেও কাজ করেছেন। লোকটা এদিন সারাক্ষণ গলা ফাটিয়েছেন। কিছু ভুল চোখে পড়লেই ছোটনকে অবহিত করেছেন। তার কথা মেয়েরা ভালো বোঝে না। হাবভাব দেখে মনে হয়েছে বাংলায় উচ্চারণ করতে তিনি হাঁসফাঁস করছেন। তহুরার গোটা দুই মিস দেখে পারলে কেঁদে ফেলেন! সারাক্ষণ আঁখির পজিশন চোখে রাখেন। আঁখি এদিক-ওদিক হলেই চেঁচিয়ে উঠছিলেন, ‘আঁকি…কামঅন। আঁকি সাবাস!’
পল স্মলি
ম্যাচ শেষ হতে সবার আগে মাঠ ছাড়েন তিনি। যাওয়ার সময় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয়, ‘আঁকি (আঁখি) আমাদের অন্যতম সেরা শক্তিশালী খেলোয়াড়। দেখলে পিকের কথা মনে পড়ে। গেমপ্লান সম্পর্কে জানতে চাইলে নিজে কৃতিত্ব নিতে চাইলেন না, ‘আসল পরিকল্পনা তো ছোটনেরই। আমি চেষ্টা করেছি কম্বিনেশনে অংশ নিতে।-চ্যানেল আই
এমটি নিউজ/আ শি/এএস