ফরিদ উদ্দিন আহমেদ: হীরামণির ঘরে তিন কন্যার পর এসেছে এক পুত্রসন্তান। এতে আনন্দে বুক ভরে যায় দম্পতির ও স্বজনদের। কিন্তু শিশুটি পূর্ণাঙ্গ রূপে পৃথিবীতে আনতে বাদ সাধে প্রকৃতি। শিশুটির মা বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে দিন গুনছেন। আর চিকিৎসকের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। কখন তার প্রাণের টুকরা স্বাভাবিকভাবে পৃথিবীতে অন্য দশটি শিশুর মতো বেঁচে থাকবে। হীরামণি বলেন, চিকিৎসকরা আশ্বাস দেয়ার পর আশায় বুক বেঁধেছেন তিনি। চিকিৎসকরা তাকে জানিয়েছেন, আগামী ২০শে জুন প্যারাসাইটিক যমজকে আলাদা করতে অস্ত্রোপচার করা হবে। শিশুটির নাম মোহাম্মদ আলী। বয়স ৩ মাস ৭ দিন। অপূর্ণাঙ্গ যমজ শিশুটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) শিশু সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. রুহুল আমিনের অধীনে ভর্তি রয়েছে।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, পূর্ণাঙ্গ শিশুটি আরেকটি শিশুর শরীরের প্রায় অর্ধেক অংশ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। চলতি বছরের গত ৭ই মার্চ তার পৃথিবীতে আসা। সে একটি পূর্ণাঙ্গ শিশু। কিন্তু তার ওপর ভর করে আছে আর একটি শিশু। যার অবস্থান পেটের নিচের অর্ধেকসহ শরীরের নিম্নাঙ্গে। ঊর্ধ্বাঙ্গের মাথা, বুক ও দুই হাত নেই অর্থাৎ আংশিক বা অপূর্ণাঙ্গ শিশুটি তার আংশিক অস্তিত্ব নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ শিশুর ওপর ভর করে বেঁচে আছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয়, প্যারাসাইটিক টুইন বা অপূর্ণাঙ্গ জমজ। প্যারাসাইটিক টুইন সমস্যা নিয়ে জন্মানো এ শিশুটির স্বাভাবিক জন্ম দেন বাগেরহাটের হীরামণি। এর আগে শিশুটির মা হীরামণি তিনটি সুস্থ স্বাভাবিক কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছেন। মোহাম্মদ আলী হলো তার চতুর্থ সন্তান। শিশুটির বাবার নাম মো. জাকারিয়া। শিশুটিকে ডা. মো. রুহুল আমিনের অধীনে ভর্তি করানো হয়, জন্মের তৃতীয় দিন অর্থাৎ ১০ই মার্চ। বর্তমানে সি ব্লকের ৫ম তলায় ৫ডি ওয়ার্ডে ফ্রি বেডের ১৩ নম্বর বিছানায় রয়েছে। এখানে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক, সেবিকাদের নিবিড় পরিচর্যায় শিশুটির চিকিৎসাসেবা চলছে বলে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র বলছে।
বিএসএমএমইউ’র প্রশাসনের সহায়তায় শিশু সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে চিকিৎসকরা শিশুটিকে ভারমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অপূর্ণাঙ্গ শিশুটির একটি কিডনি, মূত্রাশয় ও পুঃলিঙ্গ রয়েছে। অপূর্ণাঙ্গ জমজ শিশুটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। অপূর্ণাঙ্গ শিশুটি সংযুক্ত আছে পূর্ণাঙ্গ শিশুটির পেটের ডান দিকে এবং অপূর্ণাঙ্গ শিশুটির পিঠের হাড় পূর্ণাঙ্গ শিশুটির বুকের হাড়ের সঙ্গে মিশানো আছে। এছাড়া পূর্ণাঙ্গ শিশুটির নাভিও অসম্পূর্ণ যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় এক্সমফালোস। এর ভেতরের যকৃৎ ও খাদ্যনালী রয়েছে একটি পর্দা দিয়ে ঢাকা অবস্থায়। এটাকেও একটি জটিল অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে নাভির অসম্পূর্ণতা ঠিক করে দিতে হবে। আগামী সপ্তাহে এ পূর্ণাঙ্গ শিশুটির ওপর ভর করা অপূর্ণাঙ্গ শিশুটিকে আলাদা করা হবে। পূর্ণাঙ্গ শিশুটিকে অপূর্ণাঙ্গ শিশু থেকে আলাদা করার পাশাপাশি পূর্ণাঙ্গ শিশুটির নাভির অপূর্ণতাও ঠিক করে দেয়া হবে। এ জটিল অপারেশনে সহযোগিতায় থাকবে অ্যানালজেশিয়া, অ্যানেসথেশিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগ এবং নবজাতক বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
অপূর্ণাঙ্গ জমজ শিশুটির চিকিৎসকার বিষয়ে শিশু সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. রুহুল আমিন জানান, বিএসএমএমইউর ভিসি অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান প্যারাসাইটিক টুইন সমস্যা নিয়ে জন্মানো শিশুটির চিকিৎসার ব্যয়ভার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বহন করবে বলে আশ্বাস প্রদান করেছেন। ভিসির আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে প্যারাসাইটিক টুইন সমস্যা নিয়ে জন্মানো শিশুটিকে অপূর্ণাঙ্গ শিশু থেকে আলাদা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিশু সার্জারি বিভাগ। প্রসঙ্গত, বিএসএমএমইউর শিশু সার্জারি বিভাগ অতীতেও এ ধরনের জটিল অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে গৌরবোজ্জ্বল নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করে আসছে।
গত ২০০৮ সালে বহুল আলোচিত বন্যা ও বর্ষাকে মাত্র তিন মাস বয়সে শিশু সার্জারি বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. শফিকুল হকের নেতৃত্বে দীর্ঘ ৮ ঘণ্টাব্যাপী সফল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আলাদা করা হয়েছিল। তবে বর্ষার হৃদযন্ত্র বন্যার ওপরে নির্ভরশীল থাকায় আলাদা করার পর বর্ষাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। গত ২৪শে মার্চ ২০১৬ তারিখে বন্যার আট বছর পূর্ণ হয়েছে। এছাড়া বিএসএমএমইউর শিশু সার্জারি বিভাগে সফল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আরও একটি শিশুর পেটের ভেতর থেকে তিনটি অসম্পূর্ণ শিশু বা প্যারাসাইটিক ট্রিপলেট বের করে আনা হয় বা অপসারণ করা হয় বলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।-এমজমিন
১৫ জুন,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ