সোমবার, ৩০ মে, ২০১৬, ০১:৫৮:৫১

এবার বাংলাদেশি বজরঙ্গি ভাইজান!

এবার বাংলাদেশি বজরঙ্গি ভাইজান!

এম জসীম উদ্দীন: বলিউডের ‘বজরঙ্গি ভাইজান’ সিনেমাটি দর্শকের মাঝে বেশ সাড়া ফেলছিল। ভারতে এসে হারিয়ে যাওয়া পাকিস্তানি বাকপ্রতিবন্ধী ছয় বছরের শিশুকে পাকিস্তানি গণমাধ্যমকর্মীর সহায়তায় তার বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন সালমান খান। এ জন্য পরিবার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে হেনস্তা সহ্য করতে হয়েছিল সল্লুকে। এটা সিনেমার কাল্পনিক হলেও বাস্তবে এবার এক ‘বজরঙ্গি ভাইজানে’র খোঁজ মিলেছে বরগুনায়!

৫২ বছর বয়সী এই ‘বজরঙ্গি ভাইজানে’র নাম জামাল ইবনে মুসা। বাড়ি বরগুনার বেতাগী উপজেলার গেরামর্দন গ্রামে। তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টায় দিল্লি থেকে ছয় বছর আগে পাচার হয়ে বাংলাদেশে আসা ১১ বছর বয়সী (বর্তমান বয়স) সনুকে বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার পথ তৈরি হয়েছে। আর এ জন্য জামাল মুসাকে কম খেসারত দিতে হয়নি। দুটি মিথ্যা মামলায় তিনি এক মাস ২৪ দিন জেল খেটেছেন। হারাতে হয়েছে জীবিকার একমাত্র অবলম্বন ঢাকার বেসরকারি একটি কোম্পানির চাকরিও। এমনকি চারটি মিথ্যা মামলায় আসামি হয়েছেন তিনি, তাঁর ছেলে ও পরিবারের কয়েকজন। ছেলে ফেরদৌস, শ্যালক জাহাঙ্গীরও জেল খেটেছেন ১৯ দিন। তবু তিনি হাল ছাড়েননি। গাঁটের পয়সায় দিল্লি গিয়েছেন। ১৫ দিন দিল্লির পথে পথে ঘুরে খুঁজে বের করেছেন শিশু সনুর বাবা-মাকে। এ জন্য জামাল ইবনে মুসা এখন ভারতীয় গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ‘বাংলাদেশি বজরঙ্গি ভাইজান’ হিসেবে আলোচিত হচ্ছেন।

জামাল ইবনে মুসা এখন দিল্লিতে আছেন। তিনি বলেন, ‘পরিবার ও আমার ওপর দিয়ে গত কয়েক বছরে যে ঝড় গেছে তাতে এখন আর কোনো আক্ষেপ নেই। আমার মতো নগণ্য এক ব্যক্তির চেষ্টায় সনু ওর বাবা-মাকে কাছে যেতে পারবে, এতেই আমি খুশি। সনুর বাবা-মা ও প্রতিবেশীদের আনন্দ দেখে আমার সব দুঃখ-কষ্ট ধুয়ে গেছে।’ জামাল ইবনে মুসা আরও বলেন, ভারতীয় গণমাধ্যম যখন আমাকে ‘বাংলাদেশি বজরাঙ্গি ভাইজান’ নামে অভিহিত করেছে তখন তার আগা-মাথা কিছুই বুঝিনি। জানতাম না ‘বজরঙ্গি ভাইজান’ কে! এরপর ওরা (ভারতীয় গণমাধ্যম কর্মীরা) আমাকে ওই সিনেমার কথা যখন বলে তখন আমি বুঝতে পারি ওরা আমাকে কি সম্মানই না দিয়েছে! কিন্তু আমি কোনো সম্মান পাওয়ার জন্য এ কাজ করিনি। করেছি মানবিক দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে। আমাদের তো এমনটাই করা উচিত। জামাল ইবনে মুসা জানান, গত ১৪ মে তিনি দিল্লি যান শিশু সনুর বাবা-মাকে খুঁজে বের করার জন্য। সনুর কাছ থেকে আবছা আবছা তথ্য পেয়ে তিনি দিল্লি যান। অনেক খুঁজে অবশেষে ১৯ মে দিল্লির দিলসান গার্ডেন নামে একটি এলাকায় খোঁজ পান সনুর বাবা মেহবুবের। মেহবুব সেখানে একটি গাড়ি মেরামত কারখানার শ্রমিক। জামাল ইবনে মুসা জানান, তিনি মেহবুবকে সনুর ছবি দেখান। মেহবুব ছেলের ছবি দেখে চমকে ওঠেন।

মেহবুব বলেন, ‘এটাই আমার হারিয়ে যাওয়া ছেলে সনু!’ ছবি দেখে তিনি ভীষণ আনন্দিত হয়ে হাতের কাজ ফেলে জামালকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন। মেহবুব তর সইছিল না। মেহবুব বললেন, ‘চলেন ভাইজান ওর মাকে ছবিটা দেখাই, শুভ সংবাদটা দিই।’ সনুর মা মমতাজের কাছে গিয়ে ঘটনা খুলে বলেন জামাল। হারিয়ে যাওয়া ছেলে সনুর ছোটবেলার ছবি জামাল ইবনে মুসাকে দেখান মেহবুব-মমতাজ। জামালের দেওয়া ছবি ও মেহবুব-মমতাজের কাছে থাকা সনুর ছোটবেলার ছবির সঙ্গে মিলে যায়। দীর্ঘ ছয় বছর ধরে হারিয়ে যাওয়া ছেলের খোঁজ পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান মেহবুব-মমতাজ দম্পতি। আনন্দাশ্রু তাঁদের চোখে। প্রতিবেশীরা মেহবুবের বাড়িতে জড়ো হয়ে আনন্দে শামিল হন। মিষ্টি বিতরণ করে এই আনন্দকে উদ্‌যাপন করা হয়। পাড়া-প্রতিবেশী এবং সনুর বাবা-মা জামাল ইবনে মুসাকে এমন মহতি কাজের জন্য কৃতজ্ঞতা জানান।


এরই মধ্যে জামাল ইবনে মুসার এই সাফল্যের কাহিনি ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ভারতবর্ষে। ২৫ মে সনুকে বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছে দেওয়া নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে ভারতের বেসরকারি সংবাদ বিষয়ক টেলিভিশন চ্যানেল আইবিএন-৭। এরপর শুরু হয় সনুকে ভারতে তার বাবা-মায়ের কাছে ফিরিয়ে নেওয়ার সরকারি উদ্যোগ।


সনুকে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ গত ২৪ মে চারটি টুইট বার্তা দেন। এর একটিতে তিনি লিখেন, ‘আমাদের যুগ্ম সচিব সুপ্রিয়া রঙ্গনাথান এরই মধ্যে সনুর বাবা-মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তাঁরা (সনুর বাবা-মা) দাবি করছেন, সনু বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থান করছে এবং সে তাঁদের সন্তান।’ এই বার্তাটি রিটুইট হয়েছে ১৬০ বার। অপর এক টুইটে সুষমা স্বরাজ লেখেন, ‘আমরা সনুর ও তার বাবা-মায়ের ডিএনএ পরীক্ষা করাব এবং ইতিবাচক ফলাফল পেলে কোনোরকম বিলম্ব ছাড়াই অল্প সময়ের মধ্যে সনুকে তার বাবা-মায়ের কাছে ফিরিয়ে আনা হবে।’ এই বার্তাটি ১৭২ বার রিটুইট হয়েছে।

বরগুনা জেলা জজ আদালতের কর্মকর্তারা জানান, সনু গত বছরের ২২ ডিসেম্বর থেকে বরগুনার অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিমের নির্দেশ অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় পরিচালিত যশোর জেলার কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে আছে। কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পরিচালিত পাঠশালায় তাকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়েছে। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বাবুল হোসেন বলেন, ‘৫-৬ মাস আগে উন্নয়ন কেন্দ্রে আসে সনু। আমরা জানতে পারি তার বাড়ি ভারতে। সে নিয়মিত স্কুলে যায়। পড়াশোনা করে। সে ক্লাসের ক্যাপ্টেন।’ যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক মো. শাহাবুদ্দিন বলেন, ‘ভারতের দূতাবাস কর্মকর্তারা ২৫ মে এখানে এসে সনুর তথ্য নিয়ে গেছেন। তার প্রকৃত অভিভাবকদের কাছে হস্তান্তর প্রক্রিয়া চলছে।’

সনুকে দেশে আনা হয় ভাগনে পরিচয়ে: শনিবার গেরামর্দন গ্রামে জামাল ইবনে মুসার পরিবার ও গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল এর পেছনের সব কাহিনি জানা গেল। জামাল ইবনে মুসার ছেলে ফেরদৌস বলেন, ‘আমরা এখনো পলাতক আসামি। আমাদের নামে মানব পাচারের মামলাসহ আরও তিনটি মামলা রয়েছে। বাবা ও আমাদের অপরাধ একটাই, পাচারের শিকার ছোট্ট শিশুর পাশে দাঁড়ানো।’ ফেরদৌস বলেন, ২০১০ সালে সনুকে এই গ্রামে নিয়ে আসেন আকলিমা ও রহিমা নামে দুই বোন। তাঁরা সাত বোনের ছয়জনই দিল্লিতে থাকেন। তাঁদের বড় বোন হাসি বেগম বাড়িতে থাকেন। এর আগে তিনিও দিল্লিতে থাকতেন। প্রথমে সনু হিন্দি ভাষায় কথা বলত। এখন সে বাংলা পারে।

এখানে আনার পর হাসি বেগম সনুকে বোনর ছেলে বলে পরিচয় দিয়ে নাম রাখেন আমিন। কিন্তু এতটুকু শিশুকে দিয়ে হাসি বেগম গরুর ঘাস কাটা, গরু-ছাগল চরানো, বাড়ির হাঁড়ি-পাতিল ধোয়া, পানি আনাসহ সব ধরনের ভারী কাজ করাত। সামান্য এধার-ওধার হলেই শিশুটিকে নির্দয় নির্যাতন চালানো হতো। ও কাঁদলেও কেউ সাহস করে র প্রতিবাদ করত না। কারণ প্রতিবাদ করলেই যে কারও বিরুদ্ধে হাসি ও তার বোনেরা মিথ্যা মামলা ঠুকে দিয়ে হয়রানি করত। মারধর ও নির্যাতনের কারণে শিশুটি প্রায়ই পালিয়ে অন্য জায়গায় যেত। আবার খুঁজে আনা হতো। গত বছরের নভেম্বরের শেষের দিকে সৌর বিদ্যুতের ব্যাটারির ক্লিপ ভেঙে ফেলায় হাসি বেগম সনুকে হাত-পা বেঁধে বেদম মারধর করেন। ভয়ে ওই দিনই হাসির বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় শিশুটি।

২৯ নভেম্বর জামাল ইবনে মুসা সনুকে বরগুনা শহরের টাউন হল এলাকার বাসস্ট্যান্ড থেকে উদ্ধার করে বরগুনা-১ আসনের সাংসদ ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর বাড়িতে নিয়ে সেখানে রাখেন। পরে সমাজসেবা কর্মকর্তার মাধ্যমে বরগুনার মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে হাজির করেন সনুকে। আদালত সনুর জবানবন্দি শুনে তাকে যশোরের কিশোর উন্নয়নকেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশ দেন। সনুকে আদালতে হাজিরার দিনে আদালত থেকে বের হওয়ার পর আগের একটি মারামারির মামলায় জামাল ইবনে মুসাকে গ্রেপ্তার করানো হয়। ওই মামলায় ১৯ দিন জেল হাজতে ছিলেন জামাল।
এরপর সনুকে অপহরণের অভিযোগে ২১ ফেব্রুয়ারি জামাল ইবনে মুসা, ফেরদৌস, শ্যালক জাহাঙ্গীরসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মানবপাচার আইনে বেতাগী থানায় একটি মামলা করেন হাসি বেগম। ওই মামলায় ৬ মার্চ জামাল ইবনে মুসা বরগুনার অতিরিক্ত জেলা জজ আদালতে হাজির হলে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। ১০ এপ্রিল তিনি জামিনে মুক্তি পান।


হাসি বেগমের করা মানব পাচার মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা বেতাগী থানার উপপরিদর্শক জহিরুল ইসলাম আজ রোববার বলেন, ‘মামলাটি তদন্তাধীন আছে।’
মানবপাচারের অভিযোগের ব্যাপারে হাসি বেগম গতকাল শনিবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, সনু আমার এক বোনের স্বামীর আগের ঘরের ছেলে। ওকে লালন-পালনের জন্য ২০১০ সালে আমার কাছে পাঠানো হয়েছিল। আমার সাত বোনের ছয়জনই দিল্লিতে কাজ-কর্ম করে রোজগার করে। মাঝে-মধ্যে দেশে আসে বেড়াতে। এখন আমাদের অবস্থা ভালো হয়ে গেছে বলে জামাল ও গ্রামের অন্য লোকদের চক্ষুশূল হয়ে গেছে। এ জন্য সনুকে ফুসলিয়ে নিয়ে ওরা এই নাটক করছে।-প্রথম আলো

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে