রাহাত খান : বরিশালে ভোটের রাজনীতিতে বরাবরই এগিয়ে বিএনপি। জাতীয় কিংবা স্থানীয় যে কোনো নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর চেয়ে বিএনপি প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের বিস্তর ফারাক। আর জোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিই মূল কথা।
নামে ১৪ দলীয় কিংবা ২০ দলীয় জোট হলেও শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ছাড়া তৃণমূলে তেমন ভিত্তি নেই জোটের অন্য শরিক দলের। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতে তাদের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও ন্যাপের ২/৩ জন নেতা ছাড়া এসব দলের অন্য কর্মী-সমর্থক দেখা যায় না।
একইভাবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের যে কোনো কর্মসূচিতে জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ও কিছু ছদ্মবেশী কর্মী এবং ইসলামী ঐক্য জোট, পিপলস পার্টি, বিজেপি ও কল্যাণ পার্টির ২/১ জন নেতা ছাড়া কাউকে দেখা যায় না। আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির কর্মী-সমর্থক ছাড়া দুই জোটের কর্মসূচি সফল করা অসম্ভব।
স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ‘নামেই জোট, এই জোটে বড় দুই দল ছাড়া তাদের শরিক দলগুলোর কোনো জনসমর্থন, এমনকি যথেষ্ট সংখ্যক কর্মীও নেই। সুতরাং এসব দল নিয়ে জোট করলে নামে জোট ভারী হয়, কিন্তু ভোটের মাঠে তেমন প্রভাব পড়ে না।’
১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে বিপুল ভোটে হারিয়ে বরিশাল সদর আসনে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপির অ্যাডভোকেট আবদুর রহমান বিশ্বাস। পরে তিনি রাষ্ট্রপতি হলে শূন্য আসনে উপ-নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে বিপুল ভোটে হারিয়ে এমপি নির্বাচিত হন বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার। ’৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে বিপুল ভোটে হারিয়ে সদর আসনের এমপি নির্বাচিত হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের ছেলে ডা. এহতেশামুল হক নাসিম বিশ্বাস।
১৯৯৮ সালে নাসিম বিশ্বাস এমপির অকাল মৃত্যুতে শূন্য আসনে উপনির্বাচনেও আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে প্রায় দ্বিগুণ ভোটে হারিয়ে এমপি হন সরোয়ার। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী অ্যাডভোকেট শওকত হোসেন হিরণকে প্রায় অর্ধ লাখ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে তৃতীয়বারের মতো এমপি হন বিএনপি নেতা সরোয়ার। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে ১৪ দল তথা মহাজোটের প্রার্থী কর্নেল জাহিদ ফারুক শামীম (অব.) ঘাম ঝরিয়ে দেন বিএনপি তথা চারদলীয় জোটের প্রার্থী সরোয়ারের। অর্ধ লাখ ভোটের ব্যবধান কমিয়ে মাত্র ৬ হাজার ভোটে সরোয়ারের কাছে পরাজিত হন কর্নেল জাহিদ ফারুক (অব.)।
২০১৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারা দেশের মতো বরিশাল সদরেও প্রার্থী দেয়নি বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট। ফলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সদর আসনে এমপি হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট শওকত হোসেন হিরণ। জাতীয় নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও বরিশালে এগিয়ে বিএনপি। ২০০৩ সালে বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ তথা ১৪ দলীয় জোট সমর্থিত প্রার্থী অ্যাডভোকেট এনায়েত পীর খানকে বিপুল ভোটে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন বিএনপি তথা চারদলীয় জোট সমর্থিত প্রার্থী অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার। ওই নির্বাচনে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন বর্তমান মেয়র আহসান হাবিব কামাল ও এবায়েদুল হক চাঁন।
২০০৮ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী দেয়নি বিএনপি। তারপরও স্বতন্ত্র প্রার্থী সরদার সরফুদ্দিন আহম্মেদ সান্টুকে মাত্র ৫০০ ভোটে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী অ্যাডভোকেট শওকত হোসেন হিরণ। ওই নির্বাচনেও বিএনপির দুই বিদ্রোহী প্রার্থী বর্তমান মেয়র আহসান হাবিব কামাল ও এবায়েদুল হক চাঁন মোট ভোট পেয়েছিলেন প্রায় ৩৫ হাজার। পরিষদের দ্বিতীয় মেয়াদে নগরীর ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে সবার মুখে মুখে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন হিরণ। কিন্তু তারপরও ২০১৩ সালের ১৫ জুনের সব শেষ সিটি নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী আহসান হাবিব কামালের কাছে প্রায় ১৮ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিরণ।
দ্বিতীয় দফায় উপজেলা পরিষদ প্রথা চালুর পর ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে বরিশাল সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজিজুল হক আক্কাসের কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী মনিরুল ইসলাম ছবি। যদিও ২০১৪ সালের তৃতীয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী সাইদুর রহমান রিন্টু। ওই নির্বাচনে ভোট গ্রহণ শুরুর পরপরই ৬৬টি কেন্দ্রের সব দখল করে জাল ভোট দেওয়ার অভিযোগে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ভোট বর্জন করেন বিএনপির প্রার্থী অ্যাডভোকেট এনায়েত হোসেন বাচ্চু।
মহানগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজালুল করিম বলেন, কিছু কিছু ব্যক্তিবিশেষের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে বরিশাল সদরে ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ এক সময় নেতিবাচক অবস্থানে ছিল। কিন্তু ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে শওকত হোসেন হিরণ সদর আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার পর বরিশাল সদরে ভোটের রাজনীতির হিসাব-নিকাশ পাল্টাতে শুরু করে। হিরণের নেতৃত্বে বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগ অনন্য উচ্চতায় উঠেছিল। যার সুফল পাওয়া গিয়েছিল ২০০৮ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে হিরণের জয়লাভের পর তার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে মানুষের মধ্যে একটি আস্থার ভাব তৈরি হয়।
হিরণ জীবিত না থাকলেও তার কর্মকালীন সময়ের যে উন্নয়ন প্রতিচ্ছবি মানুষ দেখেছে, সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে আওয়ামী লীগ। তিনি বলেন, ১৪ দলীয় জোটের কর্মসূচিতে শরিক দলগুলোর অনেক নেতা-কর্মী অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টির অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। বরিশাল মহানগরে ১৪ দলের সমন্বয় কমিটি হয়েছে। এখানে ১৪ দলে বিরোধ নেই। বরং হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছে বলে দাবি করেন অ্যাডভোকেট আফজাল। বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস এমপি বলেন, সাধারণ ভোটাররা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে এবং উন্নয়নে বিশ্বাস করে। এ কারণে তারা শহরকেন্দ্রিক রাজনীতিতে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলকে সমর্থন করেন।
তিনি বলেন, বরিশালে ১৪ দলের মধ্যে পাঁচটি দল সক্রিয়। বাকি দলগুলোর অস্তিত্ব নেই। তাই পাঁচ দল নিয়েই বরিশালে ১৪ দলের কার্যক্রম চলে। শরিক দলগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে যাচ্ছে। বরিশাল মহানগর ওয়ার্কার্স পার্টির আহ্বায়ক শান্তি দাস বলেন, বরিশালে জোটের রাজনীতি চলে না। অন্যান্য জায়গায় ১৪ দলীয় জোট সক্রিয় থাকা সত্ত্বেও বরিশালে ১৪ দলীয় জোটের কার্যক্রম তেমন নেই। জোটে মূল দল আওয়ামী লীগ। জোটে যে ধরনের কার্যক্রমের গুরুত্ব থাকা উচিত, তারা (আওয়ামী লীগ) সেটা গুরুত্ব দেয় না। তারা মনে করে তারা বড় দল, তারা যা করে তা-ই যথেষ্ট।
জেলা ১৪ দল সমন্বয় কমিটির সদস্য কেন্দ্রীয় জাসদের (আম্বিয়া-প্রধান) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বাদল বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোটের বিরুদ্ধে পরিচালিত আন্দোলনে জেলা জাসদের সক্রিয় ভূমিকা থাকলেও পরবর্তীতে ভোটের রাজনীতিতে জাসদকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। উজিরপুর এবং বাকেরগঞ্জের মতো উপজেলায় জাসদের যে জনসমর্থন আছে, আগামীতে সেসব স্থানে জাসদকে মূল্যায়ন করা হবে বলে আশা তার। ১৪ দলের মতো দশা বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটেও। এখানে ২০ দলীয় জোটের ব্যানারে বিভিন্ন স্থানীয় ও জাতীয় কর্মসূচি পালিত হলেও জোটের প্রধান বিএনপি ছাড়া অন্যান্য শরিক দলের তেমন অংশগ্রহণ থাকে না।
তবে মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন শিকদার জিয়ার দাবি, এখন জোটের তেমন কর্মসূচি নেই। যখন জোটের কর্মসূচি থাকে তখন জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্য জোট, পিপলস পার্টি, বিজেপি ও কল্যাণ পার্টিসহ সব দলেরই কমবেশি অংশগ্রহণ থাকে। বরিশাল মহানগর বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, আগামী ভোটের আগে বাংলাদেশের সব গণতান্ত্রিক দল ঐক্যবদ্ধ হবে এবং বরিশালের ভোটের মাঠেও এর প্রভাব পড়বে। বরিশালে ভোটের রাজনীতিতে বিএনপি-ই নেতৃত্বস্থানীয় অবস্থায়। এখানে ২০ দলীয় জোটের মধ্যে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান এবং জোটের যে কোনো কর্মসূচি ঐক্যবদ্ধভাবেই পালন করা হয় বলেও তিনি জানান।
বরিশাল মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারি জহিরউদ্দিন মু. বাবর বলেন, স্থানীয়ভাবে জোটের মধ্যে সম্পর্ক অটুট আছে। এখানে ভুল বোঝাবুঝির কোনো অবকাশ নেই। জোটগতভাবে কর্মসূচি এলে অতীতের মতোই জামায়াতের অংশগ্রহণ থাকবে। ভোটের রাজনীতিতেও অতীতের তুলনায় জামায়াতের ভোট এবং অবস্থান আরও সুদৃঢ়। আগামীতে নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে এর প্রভাব এবং বাস্তবতা দেখা যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। বিডি প্রতিদিন
২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি