নিউজ ডেস্ক: জুট মিল বন্ধ। অভাবের সংসার। গৃহকর্তার আয় নেই। একটি ঘরে দশ সদস্যের গাদাগাদি বাস। পরিবারের ষষ্ঠ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল (১৪)। সে নবম শ্রেণির ছাত্র। যেমন লেখাপড়া তেমন খেলাধুলা। এলাকায় তার যেন তুলনা নেই। মেধাবী ও বিনয়ী ছাত্র বলে শিক্ষক ও সহপাঠী মহলে বেশ জনপ্রিয় মোস্তাফিজ। স্কুলের বেতন মওকুফ। বন্ধু ও উৎসাহীদের সহযোগিতায় বিএল কলেজ মাঠে নিয়মিত ক্রিকেট প্র্যাকটিস করে। সে ক্রিকেট বিস্ময় মোস্তাফিজের মতো বল করে। সবাই তাকে জুনিয়র মোস্তাফিজ বলেও ডাকে।
মোস্তাফিজের বড় শখ ছিল তার একটা বাইসাইকেলের। কিন্তু অভাবে সংসার, এমন আবদার এত দিন পূরণ হয়নি তার। তবে পরিবারের সবাই মিলে গতকাল তাকে একটি বাইসাইকেল কিনে দেয়। সেই সাইকেলে চড়ে কোচিং থেকে বাড়ি ফিরছিল সে। কিন্তু পথে ট্রাকের (লরি) ধাক্কায় তার প্রাণ পাখিটি উড়ে যায়। রাস্তায় পড়ে থাকে খালি খাঁচা। খুলনা মহানগরীর খুলনা-যশোর মহাসড়কের ফুলবাড়ীগেট এলাকায় এ দুর্ঘটনাটি ঘটে।
মোস্তাফিজ সোনালী জুট মিল স্কুলের নবম শ্রেণিতে পড়ে। তার বাবা ফজলুর রহমান বন্ধ হয়ে যাওয়া সোনালী জুট মিলের বেসিং বিভাগের সরদার ছিলেন।
ফুলবাড়ীগেটের অদূরে সোনালী জুট মিল কলোনির একটি বাড়িতে বাস করেন ফজলুর রহমান, তাঁর স্ত্রী ও তাঁদের আট সন্তান। এর মধ্যে ষষ্ঠ সন্তান মোস্তাফিজ বেশ মেধাবী। তাকে নিয়ে ছিল পরিবারের, এলাকাবাসীর বাড়তি উৎসাহ। সবার প্রিয়পাত্রও ছিল সে।
বড় বোন শাহনাজ পারভীন বলেন, ‘আমার ভাইটির একটি সাইকেলের শখ ছিল। অভাবের সংসারে কষ্ট করে কিছুদিন আগে তাকে একটি বাইসাইকেল কিনে দেওয়া হয়। সেই বাইসাইকেলে চড়ে সকালে খেয়ে বাসা থেকে বের হয় কোচিং করতে। কিন্তু ভাই আমার আর জীবিত ফিরল না। ফিরল লাশ হয়ে। ভাই আমার মরে গিয়েও বাইসাইকেলটি আঁকড়ে ধরে ছিল। ’
গতকাল মোস্তাফিজের বাসায় প্রবেশের আগে থেকেই তার মায়ের চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। তিনি ক্রমাগত বলছিলেন, ‘ওরে আমার মোস্তাফিজ কোয়ানে। মোস্তাফিজ তো বাড়ি আহে না। এত মানুষ আইল আমার মোস্তাফিজ আহে না কেন। কহোন আসবে মোর মোস্তাফিজ। তোমরা কওনা কেন মোস্তাফিজ কহন আসবে। ’
বিলাপ করতে করতে প্রতিবেশী-স্বজনদের আঁকড়ে ধরে মা বারবার মোস্তাফিজের কথা জানতে চাইছিলেন। তিনি কোনোমতেই বুঝতে চাইছিলেন না যে মোস্তাফিজ আর কোনো দিন ফিরবে না।
খুব নিচু একটি একচালা টিনের ঘর। বেড়াগুলো ভাঙাচোরা। মাথা নিচু করে ঘরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে একটি চৌকির ওপর মোস্তাফিজের বইগুলো এলোমেলো অবস্থায় পড়ে আছে। ১৮ বছর বয়সী শাহনাজ। মোস্তাফিজের বড় বোন। বইগুলো হাতে নিচ্ছেন, গুছিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন, আর অঝোরে কেঁদে চলেছেন। শাহনাজ বলেন, ভাই আমার ডাক্তার হতে চেয়েছিল। এ কারণে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়। মোস্তাফিজ ভালো ক্রিকেট খেলত। প্রতিদিন বিএল কলেজে যেত খেলা করতে। প্রতিদিন যাতায়াতের জন্য আব্বা টাকা দিতে পারত না। তাই ও বায়না ধরে ওকে একটা বাইসাইকেল কিনে দিতে। অভাবের সংসারে অনেক কষ্ট করে একটি বাইসাইকেল কিনে দেওয়া হয়। ওই বাইসাইকেলটিই যে ভাইয়ের জীবন কেড়ে নেবে তা বুঝতে পারিনি। ’ এই বোনটি মোস্তাফিজকে পড়াতেন। বোনটি পড়েন নার্সিং ইনস্টিটিউটে।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ফুলবাড়ীগেট লেভেলক্রসিং থেকে ১০০ মিটার দূরে দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, শত শত মানুষের জটলা। লোকজনের ভিড় ঠেলে দেখা যায়, গোলাপি রঙের শার্ট পরা মোস্তাফিজের নিথর দেহ পড়ে আছে একটি দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া বাইসাইকেলের ওপর। তার পরনে ছিল নীল রঙের ট্রাউজার। স্থানীয় লোকজন এ সময় সড়ক অবরোধ করে রাখে। তাদের দাবি ট্রাকচালককে গ্রেপ্তার করতে হবে।
প্রত্যক্ষদর্শী কামাল হোসেন বলেন, ‘বসে চা খাচ্ছিলাম। হঠাৎ বিকট একটা শব্দ হলো। সড়কের দিকে তাকিয়ে দেখি দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া একটি বাইসাইকেলের ওপর একটি শিশুর নিথর দেহ পড়ে আছে। দ্রুত গিয়ে দেখি তখনো শিশুটির মাথা ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ’
মোস্তাফিজের বাবা বজলুর রহমান প্রায় ৩০ বছর আগে কুমিল্লা থেকে খুলনায় আসেন জীবিকার সন্ধানে। তিনি কাজ নেন সোনালী জুট মিলে। মিলটি এক সময় সরকার ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেয়। এরপর কয়েক দফা মিলটি লে-অফ ঘোষিত হয়। ধারদেনা করে চলতে চলতে এক সময় বজলুর রহমানের সংসারে অভাব জেঁকে বসে। মিলে কাজ না থাকায় বিভিন্ন জায়গায় দিনমজুর হিসেবে শ্রম দিয়ে সংসারের ঘানি টানতে থাকেন। বছর দুয়েক আগে থেকে তিনি রিকশা-ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তাঁদের চার ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে মেধাবী মোস্তাফিজকে নিয়ে পরিবারটিতে স্বপ্নের জাল তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু একটি সড়ক দুর্ঘটনাই সব স্বপ্ন ধুলায় মিশিয়ে দিল।-কালের কণ্ঠ
এমটিনিউজ২৪/টিটি/পিএস