দীন ইসলাম : উপজেলা নির্বাহী অফিসার তারিক সালমনকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইতিবাচক মনোভাবের পর বদলে গেছে পরিস্থিতি। প্রশাসনের অনেক সিনিয়র কর্মকর্তা এখন আগ বাড়িয়ে তারিককে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিচ্ছেন।
কয়েক দিন আগেও বরিশালের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামান তাকে কারণ দর্শানো নোটিশ দিয়েছেন। এখন উল্টো ডিসিসহ বরিশাল জেলা প্রশাসনের কয়েক কর্মকর্তা ইউএনও তারিকের সঙ্গে নিজ থেকে যোগাযোগ করছেন।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, কয়েক দিন আগে বদলি হওয়া বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার মো. গাউস ও বরিশালের ডিসি ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামানের ভূমিকা খতিয়ে দেখছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। একজন জুনিয়র অফিসারের দুঃসময়ে কেন ডিসি সঠিক ব্যবস্থা নেননি এ নিয়েও আলোচনা হচ্ছে।
তাই এ সপ্তাহেই ডিসি’র বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে। তাকে ডিসি পদ থেকে প্রত্যাহার করা হতে পারে। এ ছাড়া বরিশাল চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে নিবিড় তদন্ত করছে আইন ও বিচার বিভাগ। বিষয়টিকে তারা ‘রহস্যজনক’ মনে করছে।
আইন ও বিচার বিভাগের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, প্রশাসন, পুলিশ ও নিম্ন আদালতের বিচারকদের মধ্যে সমস্যা তৈরির জন্য এমন ঘটনা কেউ ঘটিয়ে থাকতে পারে। কারণ ইউএনও তারিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সুপারিশ পাঠিয়েছে বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার অফিস।
তাই ইউএনও তারিক সালমানের অতীত পারিবারিক ইতিহাস খতিয়ে দেখা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও পরে ওই ছবি কার্ডে ছাপানোর প্রেক্ষাপট এবং মানহানি মামলা ও পরবর্তী বিষয়গুলো ভালোভাবে তদন্ত করলেই সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভি সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, দেশের সব জেলায় শুক্র ও শনিবার অ্যাসোসিয়েশনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ওই সব বৈঠকে বরিশালের সাবেক বিভাগীয় কমিশনার মো. গাউস ও ডিসি ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামানের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলা হয়, রাজনৈতিক হেনস্তার পাশাপাশি নিজ সার্ভিসের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে হেনস্তা হলে আমরা যাবো কোথায়। আমাদের কারা প্রটেকশন দেবেন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় জেলায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের কার্যবিবরণীর কপি এরই মধ্যে পৌঁছেছে। ওই কার্যবিবরণী অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, বরগুনা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গাজী তারিক সালমনকে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই প্রথম হেনস্তা শুরু করেন।
শিশুর আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবি দিয়ে কার্ড ছাপানোর পরই তাকে বরিশালের ডিসি শোকজ করেন। এরপর সাবেক বিভাগীয় কমিশানর মো. গাউস ইউএনও’র জবাব সন্তোষজনক নয় বলে জানান। ইউএনও সালমন তখন বরিশালের আগৈলঝাড়ায় কর্মরত ছিলেন। এরপর শাস্তি হিসেবে তারিককে বরিশালের আগৈলঝাড়া থেকে বরগুনা সদরের ইউএনও হিসেবে বদলি করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গাজী তারেক সালমনকে ডিসি শোকজ করেন ৩রা এপ্রিল। শোকজের জবাব দেয়ার পর সাবেক বিভাগীয় কমিশনার মো. গাউস ১৮ই এপ্রিল আরেকটি চিঠি দেন। ওই চিঠিতে বিভাগীয় কমিশনার উল্লেখ করেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রকাশ না করার বিষয়ে গাজী তারেক সালমন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, আগৈলঝাড়া, বরিশালকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে জবাব দাখিলের অনুরোধ করা হলে তিনি লিখিত জবাব দাখিল করেছেন।
তার দাখিল করা জবাব সন্তোষজনক নয় মর্মে প্রতীয়মান হয়। এই চিঠির অনুলিপি তিনি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকেও দিয়েছেন। সালমানকে শোকজের বিষয়ে বরিশালের ডিসি ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামান বলেন, কার্ড ছাপার পর কোনো একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ওই কার্ড নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারকে জানান।
কমিশনার আমাকে বলেন, ওনার (ইউএনও) কাছ থেকে একটা ব্যাখ্যা নাও। আমি তখন তাকে শোকজ করে ব্যাখ্যা নিই এবং বিভাগীয় কমিশনারকে তা পাঠিয়ে দিই। ইউএনও সালমনের ব্যাখ্যা যে সন্তোষজনক নয়, তা আমার কথা নয়, কমিশনারের চিঠির কথা। অভিযোগকারী ওই একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা তো বিভাগীয় কমিশনার আমাকে জানাননি।
এদিকে গত এপ্রিলের শেষে বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার মো. গাউস অতিরিক্ত সচিব হিসেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পদায়নের জন্য বদলি হয়ে ঢাকায় আসেন। তিনি বলেন, কোনো লিখিত অভিযোগ নয়, পার্টির লোকজন আমার কাছে অভিযোগ করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছবি ব্যবহারে নিয়ম-কানুন মানা হয়নি। তাই আমি ডিসিকে বলেছিলাম ইউএনওকে শোকজ করতে।
ইউএনও সালমনের জবাব কেন তার কাছে সন্তোষজনক মনে হয়নি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ছবি ব্যবহারের কিছু আইন-কানুন আছে। কার্ডে বঙ্গবন্ধুর ছবি ফার্স্ট পেজে না দিয়ে ব্যাক পেজে দেয়া হয়েছে। এ কারণে তার জবাব সন্তোষজনক মনে হয়নি আমার কাছে এবং আমি তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি।
ইউএনও গাজী তারিক সালমন জানান, আমাকে শোকজের পর জবাব দিই। এরপর আমাকে আর কোনো চিঠি দেয়া হয়নি। ২৪শে মে আমাকে আগৈলঝাড়া থেকে বদলি করা হয়। আমি জুন মাসে বরগুনা সদরে যোগ দিই।
এদিকে বরগুনা সদর উপজেলায় বদলি হয়ে যাওয়ার পর ৭ই জুন তারিকের বিরুদ্ধে বরিশাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পাঁচ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ ও মানহানির মামলা করেন বরিশাল আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট ওবায়েদ উল্লাহ সাজু। ওই মামলায় ১৯শে জুলাই প্রথমে তার জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়। এর দুই ঘণ্টা হাজতবাসের পর জামিনে ছাড়া পান তিনি।
এদিকে আদালতের আদেশের পর ইউএনও তারিককে পুলিশ ধরে নেয়ার ছবি প্রকাশের পর থেকে নিন্দার ঝড় ওঠে। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে বিস্মিত হন। এই প্রেক্ষাপটে তারিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরকারী ওবায়েদ উল্লাহ সাজুকে দল থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। সাজু বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। এমজমিন
এমটিনিউজ/এসবি