বয়স তাঁর ৭০ বছর। এখন যে বয়স, লাঠি হাতে নাতী-নাতনীর সহায়তায় চলাফেরা করার কথা। কিন্তু এই বয়সে তাঁকে প্রতিদিন উঠতে হয় গড়ে ৩০টি নারকেল গাছে। হাঁটতেও হয় ৮ থেকে ১০ মাইল। নিভৃত জীবনের এক মাত্র সঙ্গী স্ত্রী শরুফা বেগম আর ঠেলে নেয়া তিন চাকার একটি ভ্যান। এই ভ্যান কোনমতে ঠেলে চালানো যায়, প্যাডেল চেপে চালানো যায় না। সম্পদহীন এক সুখী দম্পতি তাঁরা। ৪৫ বছরের ক'ঠিন কোমলে ঘেরা দাম্পত্য জীবন তাঁদের। তিন চাকার অচল ভ্যানে হাড়হিম করা পরিশ্রম দিয়ে ডাব সংগ্রহ করে বিক্রির জন্য যখন বাজারে ছোটেন, স্ত্রী তখন পেছন থেকে ভ্যানটি ঠেলে নিতে সহায়তা করেন। সে এক দৃশ্যমান ভাবাবেগ। আবেগাপ্লুত হন পথচারীরাও।
অসম এ কাজের ব্যক্তির নাম আবেদ আলী সরদার। বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বিল্বগ্রাম নামক গ্রামে বাড়ি। ১৬ জুলাই বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলার উত্তর পালরদী গ্রামে বসে কথা হয় এ দম্পতির সাথে। করোনা মহামারিতেও থেমে নেই তাঁদের জীবন। আবেদ আলী জানান, সাত সদস্যর পরিবারের ভরণ-পোষনে একমাত্র দিনমজুর ছেলেকে সহযোগিতা করতেই এ শ্রম তাঁদের।
সাজ সকালে স্ত্রী শরুফা বেগম আর তিন চাকার অচল ভ্যানটি নিয়ে ছোটেন গ্রামের পর গ্রাম। ৩০ বছরের দিনলিপিতে প্রতিদিন হাটতে হয় ৮ থেকে ১০ মাইল। ডাব বা নারকেল পারার জন্য প্রতিদিন গড়ে ৩০টি নারকেল গাছে ওঠেন বৃদ্ধ আবেদ আলী। এ গ্রাম সে গ্রাম ঘুরে ৫০ থেকে ৬০টি ডাব নারকেল কিনে এনে বিভিন্ন বাজার কিংবা বাসস্ট্যান্ডে বিক্রি করেন। কোনদিন সন্ধ্যা কোনদিন রাতে বাড়ি ফেরেন। প্রতিদিন ৫ থেকে ৬ শ টাকা আয় করে ফিরেন আপন নীড়ে। ৩০ বছরে কোনদিন কোনো দুর্ঘটনায় পড়েননি। যতদিন বেঁচে থাকবেন শরীরে শক্তি থাকলে নারকেল গাছের সাথেই থাকবে তাঁর জীবন জীবিকার খেলা।
বৃদ্ধ অবেদ আলী জানান, এক সময় ইটভাটায় কাজ করতেন। তাদের সরদার একদিন তার মা বাবাকে তুলে অকথ্য ভাষায় গালী দিলে রাগ করে তিনি কাজ ছেড়ে চলে আসেন। বাড়িতে এসে চিন্তা করেন স্বাধীন পেশা বেছে নেয়ার। সে থেকেই এই ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় জড়িয়েছেন। এই হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও তাদের চেহারায় নেই কোনো ক্লান্তির ছাপ। তবে তাঁর জীবনে একটি আশা আছে- আজমীর শরীফ হযরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি (র.) এর মাজারে সস্ত্রীক যাওযার খুব বাসনা আছে, যদি বেঁচে থাকেন। এ জন্য কিছু টাকাও ধীরে ধীরে সঞ্চয় করে যাচ্ছেন।
স্ত্রী শরুফা বেগম জানান ৪৫ বছরের বৈবাহিক জীবনে তারা সম্পদহীন হলেও সুখি পরিবার। স্বামীর অভাবী সংসারে তিনিও এক লড়াকু সৈনিক। সুখ তারা খোঁজেন না, এই নিয়তিতেই সন্তুষ্ট তাঁরা। তবে তাঁদের স্বপ্ন নাতী আর নাতনীদের সুশিক্ষিয় শিক্ষিত করা। তারা তাদের দুর্দশার কথা কাউকে বলতে চান না। দু' বছর আগে তাঁর স্বামী একটি বয়স্কভাতার কার্ড পেয়েছেন।
গ্রামীণ জনপদের খেটে খাওয়া অগনিত মানুষের মধ্যে একটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ এই দম্পতি। সকালে পান্তাভাত, কাঁচা পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচ পেটপুরে খেয়ে বেরিয়ে পরেন। দুপুরে চিনি ছাড়া রং চা আর রুটি-কলা, রাতে মোটা চালের ভাত তাদের প্রতিদিনের খাবার।
আবেদ আলী বয়স্ক হলেও অতি রসিক মানুষ তিনি। প্রচণ্ড মনোবল নিয়ে বলেন, আপনাদের চেয়েও আমার শরীরে শক্তি বেশি। আমি কোনো ওষুধ খাই না। মাঝে মাঝে শরীর ব্যাথা করলে লতাপাতা ছেঁচে রস খাই, ঝামেলা শেষ। তিনি আরো জানান, গৌরনদী উপজেলার প্রতিটি গ্রামের পথঘাট, অলি-গলি সব তার চেনা জানা। এমনকি অনেক বাড়ির গ্রাম্য গৃহ বধুদেরকেও তিনি চেহারায় চেনেন। যতদিন বিধাতা বাঁচিয়ে রাখেন ততদিন কারো মুখাপেক্ষি না হওয়ারই বাসনা তাঁর। যদিও বয়স অনুযায়ী প্রায় অসম্ভব এই কাজ করছেন জীবন-জীবিকার তাগিদে। এ এক অসম প্রতিভা এক ব্যতিক্রমী বাস্তব গল্প। প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় আবেদ আলী দম্পতি প্রমান করেন সম্পদ ছাড়াও সুখে থাকা যায়।