ভোলা: ভোলার একটি ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসা ও অবহেলায় এক শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। অদক্ষ ওয়ার্ডবয় দুই বছর বয়সী ওই শিশুকে ইনজেকশন পুশ করার সঙ্গে সঙ্গে সে মারা যায় বলে অভিযোগ করেছে পরিবার। শিশুটির স্বজন ও এলাকাবাসীর ক্ষোভের মুখে গতকাল বুধবার রাতে পুলিশ ক্লিনিকের শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে আটক করে থানায় নিয়ে আসে। তবে ওয়ার্ডবয়সহ ক্লিনিকের প্রায় সবাই ঘটনার পরপর পলাতক রয়েছেন।
থানার পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গতকাল রাত নয়টার দিকে ভোলা সদর রোডে হাবিব মেডিকেল সেন্টারে এ ঘটনা ঘটে। মৃত শিশুর নাম আদিত্য চন্দ্র দে (২)। সে ভোলার সদর উপজেলার বাপ্তা ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের পণ্ডিতবাড়ির বাসিন্দা রতন চন্দ্র দের ছেলে। সাবেক স্বাস্থ্য পরিচালক এ টি এম মিজানুর রহমান ক্লিনিকটির মালিক। অদক্ষ নার্স, টেকনিশিয়ান ও চিকিৎসকের কারণে ওই ক্লিনিকে প্রায়ই রোগীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ রয়েছে।
মৃত শিশুর বাবা রতন চন্দ্র দে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর দুই বছর এক মাস বয়সী ছেলে আদিত্য চন্দ্র দেকে গতকাল সন্ধ্যার পর শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আবদুল কাদেরকে দেখাতে হাবিব মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যান। চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সেফট্রোন (সেফট্রিয়াক্সোন-এক গ্রাম-আইভি) ইনজেকশন দেন। ওই ইনজেকশন পুশ করার পরপরই আদিত্য মারা যায়। তিনি অভিযোগ করেন, চিকিৎসক নিপু নামের এক ওয়ার্ডবয়কে দিয়ে ইনজেকশনটি পুশ করিয়েছেন। ওই ইনজেকশন ধীরে ধীরে কয়েক মিনিট সময় নিয়ে পুশ করতে হয়। ওয়ার্ডবয় তা দ্রুত কয়েক সেকেন্ডে পুশ করায় তাঁর ছেলের মৃত্যু হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, রাত নয়টার দিকে শিশু আদিত্যের মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষুব্ধ শত শত এলাকাবাসী ও শিশুটির স্বজনেরা ক্লিনিকটি ঘিরে রেখেছে। তারা ক্লিনিকের একটি দরজা ও কয়েকটি আসবাব ভাঙচুর করেছে। চিকিৎসককে অবরুদ্ধ করে রেখেছেন। তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ এসে ভাঙচুর প্রতিরোধ করে। একপর্যায়ে রাত ১২টার দিকে পুলিশ দৌলতখান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের শিশু বিশেষজ্ঞ এবং হাবিব মেডিকেল সেন্টারের অংশীদার ডা. আবদুল কাদেরকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা চিকিৎসককে কিল-ঘুষি মারে। এলাকাবাসী ভোলা সদর রোড অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। সে সময় দাঙ্গা পুলিশ লাঠিপেটা করে সড়ক ফাঁকা করে যান চলাচল চালু করে।
ভোলা জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক গৌরাঙ্গ দে, ভোলা জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি অবিনাশ নন্দী, নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব এস এম বাহাউদ্দিন, সদর উপজেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি শান্ত ঘোষসহ আরও কয়েকজন অভিযোগ করেন, শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত হাবিব মেডিকেল সেন্টার হাবিব ক্লিনিক নামেই বেশি পরিচিত। ক্লিনিকের মূল মালিক সাবেক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। ক্লিনিকটি চালু হওয়ার পর থেকে অদক্ষ চিকিৎসক, নার্স ও টেকনিশিয়ান দ্বারা চিকিৎসা দেওয়ায় প্রায়ই রোগী মারা যাচ্ছে এবং হইচই হচ্ছে। গতকাল রাতে নিপু নামের একজন ওয়ার্ডবয়কে দিয়ে ইনজেকশন পুশ করায় রোগীর অকালমৃত্যু হয়েছে। এটি হত্যা। তাঁরা মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানান।
আটক চিকিৎসক আবদুল কাদের বলেছেন, আদিত্যের জন্মের পর থেকে তিনি চিকিৎসা করছেন। জন্মের পর থেকেই সে গুরুতর শ্বাসকষ্টের রোগী। গতকালও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায়, সে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। এ জন্যে তাঁকে এক গ্রামের সেফট্রোন ইনজেকশন দেওয়া হয়। সাধারণত ১০ কেজির ওজনের শিশুকেই এ ডোজ দেওয়া যায়। শিশুর ওজন ছিল ১৩ কেজি। এটা কোনো ভুল চিকিৎসা না। সমস্ত পৃথিবীর চিকিৎসক এই চিকিৎসাই দিতেন।
কেন মারা গেল—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইনজেকশন পুশ করার পর হাইপারসিটিভিটি রিঅ্যাকশান হয়েছে। ২০০ থেকে ৩০০ রোগীর মধ্যে দু-একটি দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এটি তা-ই। এখানে চিকিৎসকের কোনো দোষ নেই।
তবে এ ইনজেকশন খুব ধীরে পুশ করতে হয় বলে জানিয়েছেন ভোলা সিভিল সার্জন রথীন্দ্রনাথ মজুমদার। তিনি বলেন, এ ইনজেকশনটি ধীরে ধীরে ১৫ থেকে ২০ মিনিট সময় নিয়ে পুশ করতে হয়। নইলে সুস্থ-স্বাভাবিক রোগীর ক্ষেত্রেও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এ ক্ষেত্রে তা-ই ঘটে থাকতে পারে।
এদিকে হাবিব মেডিকেল সেন্টারের মূল মালিক এ টি এম মিজানুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি ঠিক জানি না কে ইনজেকশন পুশ করেছে। যদি নিপু দিয়ে থাকেন, তবে তাঁর কোনো প্রশিক্ষণ নেই। তিনি ওয়ার্ডবয় হিসেবে চাকরি নিয়েছেন।’ তিনি আরও বলেন, এখানে বেশির ভাগ নার্স নতুন ঢুকে প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করছেন। দু-একজনের সনদ আছে। তবে রোগীর চিকিৎসায় তাঁদের কোনো অবহেলা নেই বলে দাবি করেন তিনি।
ভোলা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর খায়রুল কবীর বলেন, মৃত শিশুটির পরিবার এখনো এ বিষয়ে কোনো মামলা করেনি। তবে এখন শিশু বিশেষজ্ঞ আবদুল কাদেরকে থানায় আটক রাখা হয়েছে। মামলা হলে তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হবে।-প্রথম আলো
২৪ নভেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এআর