নিউজ ডেস্ক: উচ্চ আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর গত বুধবার থেকে এলাকার মানুষের কাছে 'তারকা' বনে গেছেন ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার ফরিদাবাদ গ্রামের আবদুল জলিল। ভুল বিচারে দণ্ড মওকুফের পাশাপাশি তাকে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রকে উচ্চ আদালত নির্দেশ দিয়েছেন জেনে চমকিত চরফ্যাশনবাসী। ন্যায়বিচার পাওয়ায় তারা উল্লসিত। আশপাশের গ্রামের শত শত উৎসুক মানুষ ভিড় করছে মুক্ত আবদুল জলিলকে দেখতে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে গ্রামের খালপাড়ের খাসজমিতে গড়ে তোলা বাড়ির আঙিনায় বসে তিনি বলেন, 'বিজ্ঞ আদালতের ক্ষতিপূরণের রায়ে আমি সন্তুষ্ট। কিন্তু আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ১৪টি বছর ফেরত চাই। ফেরত চাই মামলার ফাঁদে ফেলে কেড়ে নেওয়া আমার বসতবাড়ি। যাদের ষড়যন্ত্রে এই মিথ্যা মামলায় আমাকে ফাঁসানো হয়েছে, তাদের বিচার চাই।' তিনি অভিযোগ করেন, তার নানাবাড়ির (ইসমাইল হাওলাদার) পাশেই জাফর উদ্দিনের শ্বশুরবাড়ি। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবে তিনি তাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে তার পরিবারকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করেছেন।
আবদুল জলিল জানান, হাইকোর্টের সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণার পর ১৪ বছর কারাগারে কাটিয়ে গত ২৬ এপ্রিল বরিশাল কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। মুক্তির পর জন্মভূমিতে ফিরে যান তিনি। কিন্তু তার ভিটেবাড়ি আর পাননি। পাননি বাবা হাছন আলীকেও। তিন বছর আগে মারা গেছেন তিনি। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে গ্রামে ফিরে তিনি বসবাস করছেন স্বজনদের নতুন ঠিকানা কেফড়াখালী খালপাড়ের খাসজমিতে। সেখানে তোলা ঘরে তার বৃদ্ধ মা ছালেকা বেগম বার্ধক্য আর রোগ-শোকে শয্যাশায়ী। তিন ভাই আর তিন বোনের মধ্যে আবদুল জলিল ছিলেন সবার ছোট। তাদের কোনো সহায়-সম্পত্তি নেই। তার বড় ভাই ইব্রাহীম মাছধরা ট্রলারের মাঝি এবং অপর ভাই ইসমাইল স্থানীয় একটি ডকে শ্রমিকের কাজ করছেন।
আবদুল জলিল আরও জানান, নানাবাড়ি থেকে তার মা ছালেকা বেগম ওয়ারিশসূত্রে ১০ শতাংশ জমি পান। সেখানে বসবাস করতেন তারা। কিন্তু তার ওপর চোখ পড়ে প্রতিবেশী জাফর উদ্দিনের। 'মিথ্যা' মামলা করে ওই জমি বাগিয়ে নেয় সে। জলিলদের পুরো পরিবারকে বাড়িছাড়া করে। এখন তারা খালপাড়ের খাসজমিতে থাকেন। এ খাসজমিতে স্থানীয় একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির বন্দোবস্ত মালিকানা দাবি আছে।
কারাগারে যাওয়ার আগের সময় সম্পর্কে জলিল বলেন, 'আমি তখন গ্রামের স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি। থানা পুলিশ, মামলা-মোকদ্দমা আর জেল সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। একদিন বিকেলে জাফর উদ্দিন কাজের কথা বলে আমাকে বাজারে নিয়ে যায়। সেখান থেকে থানায় নিয়ে যায়। রাতে হাতকড়া দিয়ে পুলিশ আমাকে কোর্টে পাঠায়। কোর্ট থেকে আমাকে জেলে নেওয়া হয়। তখন অন্য বন্দিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বুঝতে পারি, বিপদে পড়েছি।'
পরিপ্রেক্ষিত: ২০০১ সালের ২৪ আগস্ট চরফ্যাশন থানায় মামলা করেন নূরাবাদ ইউনিয়নের ইউডি দাখিল মাদ্রাসার সুপার মাওলানা জাফর উদ্দিন। একই বছর ১৩ নভেম্বর মামলার একমাত্র আসামি আবদুল জলিলকে গ্রেফতার করে চরফ্যাশন থানা পুলিশ। ২০০৪ সালের ৩০ আগস্ট ভোলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল আসামি জলিলকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা জরিমানার রায় দেন। তখন আসামি জলিলের বয়স ১৫ বছর হলেও মামলার বিচার হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ৯/১ ধারায়। এ রায়ের বিরুদ্ধে জেল আপিল করেন আবদুল জলিল। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ আবেদন নিষ্পত্তি করতে গিয়ে দেখেন, ঘটনার সময় তিনি নাবালক ছিলেন। অভিযোগপত্রেও তার বয়স ১৫ বছর উল্লেখ করা ছিল। ফলে একজন নাবালক হিসেবে তার বিচার পুনরায় শিশু আদালতে করার জন্য ভোলার জেলা দায়রা জজকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে বিচারিক আদালতের ওই সাজা বাতিল করেন হাইকোর্ট।
২০১০ সালের ৮ মার্চ ভোলার অতিরিক্ত দায়রা জজ নারী ও শিশু দমন বিশেষ আইনের একই ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে আবারও আবদুল জলিলকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে আবারও জেল আপিল করেন তিনি। বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে জলিলের করা জেল আপিল নিষ্পত্তি করে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমানের একক বেঞ্চ রাষ্ট্রকে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেন। গত বুধবার (১৫ মে) রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়।-সমকাল
২৭ মে,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ