আহাদ চৌধুরী তুহিন, ভোলা : ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার আমিনাবাদ ইউনিয়নের কুলসুমবাগ গ্রাম। এখানে ‘কালেমার দাওয়াত’ পল্লী নামে একটি এলাকা আছে। এ পল্লীতে পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন প্লটে ১০টি দোতালা ভবনে বর্তমানে প্রায় সাতশ’ নারী-পুরুষ সংগঠনের ‘সাথী’ পরিচয়ে বসবাস করছেন। তারা ইসলাম প্রচারের জন্য দাওয়াত দিয়ে থাকেন বলে দাবি করা হয়।
তবে সারাদেশের মতো এখানেও জঙ্গিরা লুকিয়ে থেকে আস্তানা গড়ে তুলতে পারে বলে স্থানীয়রা আশঙ্কা করছেন। কারণ, এখানে কারা থাকেন, কতদিন ধরে আছেন বা কারা চলে যাচ্ছেন, তা কর্তৃপক্ষের নজরে নেই। এমনকী তাদের তালিকাও নেই কর্তৃপক্ষের কাছে।
এ ছাড়া পুলিশের কাছেও এখানকার বাসিন্দাদের হালনাগাদ তালিকা নেই বলে জানা গেছে। সে কারণে স্থানীয়রা আশঙ্কা প্রকাশ করে জানিয়েছেন, ইসলাম প্রচারের সুযোগ নিয়ে এই পল্লীতে জঙ্গিরা আস্তানা গড়ে তুলতে পারে। তাদের দাবি, এই পল্লীকে পুলিশি নজরদারির মধ্যে আনা হোক।
এর আগে ২০১৪ সালে ভোলার ইলিশা থেকে ধর্মীয় লিফলেটসহ জঙ্গি সন্দেহে ‘কালেমা দাওয়াত’ সংগঠনের ১২ জনকে আটক করে পুলিশ। পরে চরফ্যাশন থেকে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা আবদুল মজিদসহ আরও পাঁচজনকে আটক করেছিল পুলিশ। যদিও পরে তারা জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তবে তাদের মামলা এখনও চলমান।
জানা যায়, স্থানীয় বাসিন্দা চরফ্যাশন কলেজের কৃষি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আবদুল মজিদ তাবলীগ করতে গিয়ে ইসলামের দাওয়াত প্রচারের জন্য প্রায় ১৫ বছর আগে ‘কালেমার দাওয়াত’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যারা দাওয়াত দিচ্ছেন তাদের অনেকেরই ইসলাম প্রচারের স্বীকৃত কোনও শিক্ষাগত যোগ্যতাও নেই।
এছাড়া ইসলামের দাওয়াত প্রচারের কথিত সংগঠন কালেমার দাওয়াত পল্লীতে বর্তমানে অবস্থানরত সাথীদের হালনাগাদ তথ্য এর প্রতিষ্ঠাতা আমিরের কাছেও নেই। এমনকী পুলিশের কাছেও এ বিষয়ে কোনও তথ্য নেই।
রবিবার এ পল্লীতে গিয়ে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন জেলার প্রায় সাতশ’ নারী-পুরুষ এখানে থাকছেন। অনেকেই বিভিন্ন জেলা থেকে আসছেন। আবার কয়েকদিন থেকে চলেও যাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার অনেকদিন ধরেই এখানে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। কেউ কেউ এখানে থেকে ভ্রাম্যমাণ ব্যবসাও চালাচ্ছেন।
কালেমার দাওয়াত পল্লীতে ছোট ছোট গ্রুপ করে রান্নাবান্না ও খাওয়া-দাওয়া করেন বলে এখানকার বাসিন্দারা জানান।
চরফ্যাশন এলাকার মানুষের কাছে ‘ভালো মানুষ’ খ্যাত কালেমার দাওয়াতের প্রতিষ্ঠাতা ও আমির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবদুল মজিদ এখন চোখেও ভালো দেখেন না। তিনি পল্লীর একটি কক্ষে পরিবারপরিজন নিয়ে থাকেন।
পাঁচ ছেলে ও ছয় মেয়ের জনক অধ্যাপক আবদুল মজিদ জানান, ‘নবী করিম (সা.)ইসলামের দাওয়াত প্রচার করতেন। অনেকেই এটা করেন না। তাই, তার ভক্তদের দিয়ে তিনি এটা করাচ্ছেন। ’
তিনি জানান, ‘দেশের সব জেলার ভক্তরা এখানে আসেন। এমনকী দেশের বাইরে থেকেও অনেকেই আসেন।’
সাথীদের নাম-ঠিকানাসহ তালিকা আছে কিনা জানতে চাইলে কালেমার দাওয়াতের প্রতিষ্ঠাতা ও আমির আবদুল মজিদ বলেন, ‘কয়েকমাস আগে থানা পুলিশ একবার তালিকা নিয়েছিল। তবে বর্তমানে হালনাগাদ তালিকা নেই।’
আলাপকালে তিনি বলেন, ‘তথাকথিত আইএস এবং জামায়াতে ইসলামী মূলত ইসলামের শত্রু। ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম জঙ্গিবাদ ও মানুষ হত্যা সমর্থন করে না।’
এ সময় তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, একথা তার সংগঠনের সাথীরা প্রচার করেন কিনা। জবাবে তিনি বলেন, ‘না। তবে এটা প্রচার করা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।’
পল্লীতে বসবাসকারী সাথী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. লোকমান (২৩), বানারীপাড়ার রবিয়া (২৪), পঞ্চগড়ের আবদুল আজিম (৩৪) জানান, তারা অনেকদিন ধরেই পরিবার নিয়ে এই পল্লীতে আছেন। তারা ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে বিভিন্ন মালামাল এনে এখানকার দোকানে পাইকারি এবং বিভিন্ন এলাকায় ফেরি করে বিক্রি করেন।
তাদের ভাষায় যখন তারা তাদের পণ্য বিক্রি করতে যান, তখন তারা ইসলামের প্রচার করে থাকেন। তাদের মতো অনেকেই এখানে থেকে ছোট ছোট ব্যবসা করছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চরফ্যাশন পৌরসভার মেয়র বাদল কৃষ্ণ দেবনাথ জানান, ‘মজিদ স্যার ভালো মানুষ। তবে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যেন তার সরলতার সুযোগে কোনও দুষ্কৃতিকারী বা জঙ্গি এখানে আশ্রয় না নিতে পারে।’
চরফ্যাশন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এনামুল হক জানান, ‘কলেমার দাওয়াত পল্লীর বিদেশিদের তালিকা থানায় আছে। কিন্তু সাথীদের হালনাগাদ কোনও তালিকা নেই। ’
স্থানীয়দের অভিমত, সারাদেশের মতো জঙ্গি তৎপরতা রোধে এখানেও জরুরিভাবে নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন। নইলে যে কোনও সময় নাশকতার মতো ঘটনা ঘটে যেতে পারে। -বাংলা ট্রিবিউন
০৩ আগস্ট, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম