বুধবার, ২৯ জুন, ২০১৬, ০১:৩৮:৩৯

‘এখন চিন্তা কেবল নিজেকে আর স্ত্রীকে নিয়ে’

‘এখন চিন্তা কেবল নিজেকে আর স্ত্রীকে নিয়ে’

বগুড়া: ফরিদ চাচার বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। গায়ে গতরে শ্রম দেয়ার শক্তি শেষ হয়নি এখনো। খেটে খাওয়া মানুষ তিনি। পরিবারে স্ত্রী ছাড়া এখন আর কেউ নেই। ছেলেরা বড় হয়ে আলাদা সংসার করে। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন অনেক আগেই। এখন চিন্তা কেবল নিজেকে আর স্ত্রীকে নিয়ে। দুজনের দিনে তিনবেলা ভাতের জোগাড় হলে আর কিছু লাগে না তার। তেমন কোনো বাড়তি চাহিদাও নেই। বছরে দুই-একবার স্ত্রীর জন্য মোটা এক-দুইটা শাড়ি সাথে তিন চারটা ব্লাউজ আর নিজের ফতুয়া, পাঞ্জাবি, লুঙ্গি হলেই আর কিছু লাগে না। ফরিদ হোসেন পেশায় একজন রঙমিস্ত্রি। বগুড়ার গাবতলী উপজেলায় তার বাড়ি। বড়লোকের ইটের দালান রঙ করেই তার সারা বছরের সংসার চলে। ফরিদ হোসেনের সঙ্গে আরো পাঁচজন কাজ করে। যেখানেই কাজে যায় পুরো গ্রুপ সেখানে কাজ করে। কেউ রঙ মাখে, কেউ কেরোসিন, তারপিনে মিশিনে রঙ তৈরি করে। বড় দালানের কাজে তাদের সঙ্গে আরো পাঁচ ছয়জন মিস্ত্রি যোগ দেয়।

দেয়ালের গায়ে বাঁশের মই লাগানো, পুরনো দেয়াল ঘষে পরিষ্কার করাসহ যাবতীয় কাজ তারা সমবেত ভাবে করে থাকে। ফরিদ হোসেন তাদের দল নেতা। ওদের ভাষায় ‘হেড মিস্ত্রি’। তিনি কেবল সহযোগীদের কাজের নির্দেশনা দেন। কাজ তদারকি করেন। ফিনিশিং করেন শুধু তার হাত দিয়ে। এভাবে প্রতিদিন কত মানুষের দেয়ালে তাদের স্বপ্নে তুলিতে রঙের আঁচড় ফেলান। লাল, নীল, সাদা কত রকমের রঙে দেয়ালকে রাঙিয়ে তোলেন তারা। অথচ নিজেদের বাড়িতে রঙ করার মতো দেয়াল তাদের একজনের নেই। তারপরও দিনে পর পর দিন এভাবেই কাজ করে যাচ্ছেন তারা। বিরক্তির ভাব নেই। বিরামহীনভাবেই তাদের পেশাকে কাজে লাগাচ্ছেন। প্রতিদিন কাজের সন্ধানে ফরিদ হোসেনসহ আরো অনেকে জড়ো হন বগুড়া শহরের নামাজগড় বাজারে। সূর্য ওঠার আগেই বাড়ি থেকে বের হন তারা। নামাজগড়ে সকাল সাতটার মধ্যেই উপস্থিত হতে হয়। কাজের জন্য যাবতীয় সরঞ্জামাদি নিয়ে তারা রাস্তার ধারে বসে থাকেন।

যাদের দেয়ালে রঙ করতে হবে তারাও এখনে এসে মিস্ত্রিদের সঙ্গে কথা বলে দরদাম ঠিক করে কাজের জন্য নিয়ে যায়। শুধু রঙমিস্ত্রি নয়, নামাজগড়ের ওই বাজারে সব ধরনের কাজের লেবার পাওয়া যায়। মাটিকাটা, রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, রঙমিস্ত্রি, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, গৃহস্থালির কাজসহ প্রায় সব ধরনের কাজের মানুষ এখানে পাওয়া যায়। প্রয়োজনীয় কাজের জন্য নির্দিষ্ট কাজের মানুষকে এখানে সহজেই পাওয়া। শহরে বরাবরেই লেবার সংকট থাকে। অপরদিকে গ্রামের লেবাররা সব সময় কাজ খুঁজে পায় না। বছরে দুবার ধান কাটার মৌসুম ছাড়া বাকি সময়গুলোতে গ্রামে তেমন কোনো কাজ থাকে না। এই সময়গুলোতে খেটে খাওয়া ওইসব মানুষ শহরে আসে কাজের সন্ধানে। ছোটখাটো কাজ তারা পেয়েও যায়। সারা দিন কাজ করে সন্ধ্যায় তারা বাড়ি ফিরে যায়। অপরদিকে গ্রামের ওই সব শ্রমিক শহরে কাজের জন্য আসায় শহরে বসবাসরত মানুষ যে কোনো কাজের শ্রমিক সহজেই পেয়ে যায়।

গ্রামের চেয়ে শহরের শ্রমের দাম কিছুটা বেশি পেয়ে তারাও খুশি থাকে। সামনে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ। এ ঈদকে সামনে রেখে বাসাবাড়ি, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, অফিস, মসজিদ, মাদরাসা, ঈদগাহ মাঠসহ পুরাতনকে নতুনরূপে সাজাতে সবাই এখন ব্যস্ত। সঙ্গত কারণেই চলতি সময়ে রঙমিস্ত্রিদের চাহিদা বেশি। এই সময়ে সবাই একসঙ্গে কাজে হাত দেয়ার কারণে মিস্ত্রি সংকট দেখা দিয়েছে। রঙমিস্ত্রি ফরিদ হোসেন বলেন, কাজের চাহিদা বেশি থাকায় গ্রামে বসে থাকা লোকজনদের ডেকে এনে কাজে লাগাচ্ছি। গ্রুপের শ্রমিকদের ভাগ করে দুই তিন জায়গায় পাঠিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। বর্তমানে রঙমিস্ত্রির পাশাপাশি কাঠমিস্ত্রি ও রাজমিস্ত্রিরাও ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। এই সময় তারা রিপেয়ারিংয়ের কাজ বেশি করছে। অপরদিকে বর্ষাকাল শুরু হওয়ায় অনেকেই এই সময় ঘরের চালের পুরাতন টিন পাল্টিয়ে নতুন টিন লাগায়। বৃষ্টি মৌসুম এবং সামনে ঈদ হওয়ায় একসঙ্গে সব কাজের ভিড় জমেছে।

একবারে অনেক কাজ আসায় মিস্ত্রিদের মধ্যেও বয়ে যাচ্ছে আনন্দের ধারা। কাহালু উপজেলার ভালতা গ্রামের কাঠমিস্ত্রি আবদুল জলিল, সদর উপজেলার মানিকচরের শহিদুল ইসলাম বলেন, প্রত্যেক ঈদের সময় তাদের হাতে অনেক কাজ থাকে। এই সময় কাজ করে তাদের তিন চার মাসের সংসারের খরচ চালানো যায়। তাদের ভাষ্যমতে, বগুড়া জেলায় ৫ শতাধিক রাজমিস্ত্রি, ৩ শতাধিক কাঠমিস্ত্রি, ২ শতাধিক রঙমিস্ত্রি কাজ করে। তাদের সহযোগী হিসেবে আরো অন্তত ৫ শতাধিক মানুষ এসব পেশায় কাজ করে থাকে। ঈদের সময় ছাড়া বাকি মাসগুলোতে তাদের কাজে ভাটা পড়ে। সে সময় সপ্তাহে দুই একদিন তারা কাজ পেয়ে থাকে। বাকি দিনগুলোতে তারা কোনো কাজ পায় না। এজন্য কাজের এই মৌসুমে যত বেশি পারা যায় তারা কাজ করে। এই সময়ের বাড়তি আয় দিয়েই তারা অবসর সময় পাড়ি দেয়।-এমজমিন

২৯জুন,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে