নাজমুল হুদা নাসিম, বগুড়া থেকে : হতদরিদ্র বাবা-মা ও বড় দুই বোন এখনও মানতে পারছেন না, তাদের সবার আদরের খায়রুল ইসলাম পায়েল (২০) জঙ্গি। তাদের বিশ্বাস হচ্ছে না ঢাকার গুলশানের হোটেলে দেশি-বিদেশি ২০ নিরীহ মানুষকে ধর্মের নামে গলাকেটে এবং দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে বোমা মেরে নৃশংসভাবে যারা হত্যা করেছে তাদের দলে সেও ছিল।
পরিবারের সদস্যরাতো বটেই, স্থানীয় লোকেরাও পায়েলের জঙ্গি হয়ে ওঠার ঘটনায় অবাক হয়েছেন বলে জানান। সবাই জানেন, পায়েল ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। পাশের গ্রামের সহপাঠী আবদুল হাকিম তাকে ঢাকায় নিয়ে গেছে। গত ৬ মাস বাড়ির সঙ্গে তার কোনও যোগাযোগ ছিল না।
কামারপাড়া গ্রামের আবদুর রহমানের স্ত্রী ও হাকিমের মা সুফিয়া বেগম জানান, তার ছেলে হাকিমের সঙ্গে নিহত জঙ্গি পায়েলের কোনও সম্পর্ক ছিল না। পায়েলের পরিবার এ ব্যাপারে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে। তিনি দাবি করেন, তার ছেলে হাকিম গত ৩০ জুন বৃহস্পতিবার রাত ১:৩৫ মিনিটে আজারবাইজানের উদ্দেশে ঢাকা শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করেছে।
বগুড়া ডিবি পুলিশের পরিদর্শক আমিরুল ইসলাম জানান, খায়রুল ইসলাম পায়েল তাদের তালিকাভুক্ত জেএমবির জঙ্গি। গত ২৬ এপ্রিল রাতে কামারপাড়া মধ্যপাড়া গ্রাম থেকে আবদুল মোমিন নামে তার এক সহযোগীকে একে-২২ রাইফেল, একটি পিস্তল ও ৫২ রাউন্ড গুলিসহ গ্রেফতার করা হয়েছে।
সোমবার দুপুরে বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে শাজাহানপুর উপজেলার চুপিনগর ইউনিয়নের বৃ-কুষ্টিয়া দক্ষিণপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, হতদরিদ্র কৃষক আবুল হোসেনের বাড়ির সামনে এলাকাবাসী ও পুলিশের ভিড়। এলাকাবাসীদের কেউ কেউ বলছেন, গ্রামের জাত গেছে। এখানকার কেউ আর ভালো চাকরি পাবে না। তাদের মানুষ ঘৃণা করবে। টিনের বাড়িতে তিনটি ঘর। ভাল কোনও আসবাবপত্র নেই। টিনের দরজায় পায়েলের হাতে আরবীতে ‘লা-ইলাহা ইল্লালাহু’ কলেমা লেখা। ঘরে বড় বোন হোসনে আরা বিলাপ করে কাঁদছিলেন।
রবিবার (৩ জুলাই) বিকালে বগুড়ার ডিবি পুলিশ পায়েলের লাশ শনাক্ত করতে বাবা আবুল হোসেন ও মা পেয়ারা বেগমকে নিয়ে গেছে। পুলিশ জঙ্গি পায়েলের বাবা ও মায়ের সঙ্গে কাউকে কথা বলতে বা ছবি তুলতে দেয়নি।
তিনি জানান, তাদের আদরের পায়েল ছোটবেলা থেকেই ধার্মিক ছিল। নিজে নামাজ পড়তো, রোজা রাখতো ও সকলকে ধর্মের পথে চলতে অনুরোধ জানাতো। ছবি তোলা পছন্দ করতো না। গ্রামবাসীদের সঙ্গে খুব কম মেলামেশা করতো। সে স্থানীয় বৃ-কুষ্টিয়া দারুল হাদিস সালাফিয়া মাদ্রাসায় ৭ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে। এরপর পার্শ্ববর্তী বিহিগ্রাম ডিইউ সেন্ট্রাল ফাজিল মাদ্রাসায় ভর্তি হয়। গত ২০১৪ সালে সেখান থেকে আলিম পাস করেছে।
তিনি আরও জানান, সহপাঠী ও বন্ধু পার্শ্ববর্তী কামারপাড়া গ্রামের আবদুর রহমানের ছেলে আবদুল হাকিম তাকে ঢাকায় নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কথা বলে ডেকে নিয়ে যায়। এরপর থেকে সে বাড়িতে খুব কম আসা যাওয়া করতো। অপর বোন জোৎস্না তার লেখাপড়াসহ সকল খরচ দিতেন। প্রায় ৬ মাস আগে বন্ধু হাকিমের সঙ্গে মোটরসাইকেলে সে বাড়িতে এসেছিল। এরপর আর কোনও যোগাযোগ নেই। রবিবার বেলা ১১টার দিকে প্রতিবেশিদের কাছে জানতে পারেন, তার আদরের ভাই পায়েল ঢাকার একটি হোটেলে অনেক মানুষ খুন করেছে। আর যৌথ বাহিনীর অভিযানে গুলিতে তার ভাই মারা গেছে।
তিনি দাবি করেন, যদি তার ভাই খারাপ হয়ে থাকে তাহলে পাশের গ্রামের বন্ধু হাকিমের কারণে হয়েছে। সে তাকে ঢাকা পড়াশোনা করানোর নামে বিপথে নিয়ে গেছে। তিনি ও পরিবারের সদস্যরা ভাইয়ের লাশের জন্য অপেক্ষা করছেন।
পায়েল ও তার পরিবারের ব্যাপারে কথা হয় প্রতিবেশী আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে। তিনি জানান, পায়েলের পরিবার আওয়ামীবিদ্বেষী ও জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক। পায়েল ছোটবেলা থেকেই ধার্মিক। সে আহলে হাদিসের অনুসারী। জিহাদি বই পড়তো। তাকে গ্রামের একটি মসজিদে তারাবির নামাজ পড়ানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু হাত তুলে মোনাজাত না করায় গ্রামবাসী তার বিরুদ্ধে আপত্তি তোলেন। এরপর থেকে মসজিদে সে নামাজ পড়ানো বন্ধ করে দেয়।
আব্দুর রাজ্জাকও জানান, প্রায় ৬ মাস আগে পাশের গ্রামের হাকিমের সঙ্গে মোটরসাইকেলে বাড়িতে এসেছিল। এরপর আর তার কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি।
কথা হয় শাজাহানপুর উপজেলার চুপিনগর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শাহজাহান আলীর সঙ্গেও। তিনি মনে করেন, গ্রামের দু’টি মাদ্রাসার কারণে অনেকে বিপথগামী হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে খায়রুল ইসলাম পায়েল, পার্শ্ববর্তী কামারপাড়া গ্রামের আবদুল হাকিম, ২৬ এপ্রিল রাতে অস্ত্রসহ গ্রেফতার কামারপাড়া মধ্যপাড়া গ্রামের মৃত মোজাহার আলীর ছেলে আবদুল মোমিন প্রমুখ। এদের অনেকে জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। প্রভাবশালী হওয়ায় অনেকে গ্রেফতার হয়নি। অনেকে গা-ঢাকা দিয়েছে।
বগুড়া ডিবি পুলিশের পরিদর্শক আমিরুল ইসলাম জানান, খায়রুল ইসলাম পায়েল তালিকাভুক্ত জঙ্গি। তাকে দীর্ঘদিন ধরে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছিল। ২৬ এপ্রিল রাতে তার সঙ্গী কামারপাড়া মধ্যপাড়া গ্রামের মৃত মোজাহার আলীর ছেলে জেএমবির ইসাবা গ্রুপের সদস্য আবদুল মোমিনকে একটি একে-২২ রাইফেল, একটি পিস্তল ও ৫২ রাউন্ড গুলিসহ গ্রেফতার করা হয়েছে। এ আগ্নেয়াস্ত্র দিয়েই গত বছরের ২৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় বগুড়ার শিবগঞ্জের চককানু গ্রামে মসজিদ-ই-আল মোস্তফা শিয়া মসজিদে গুলিবর্ষণ করলে মুয়াজ্জিন নিহত এবং ইমামসহ তিন মুসল্লি আহত হন। -বাংলা ট্রিবিউন
৫ জুলাই ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস