কাজী হাফিজ : লোকপ্রজ্ঞার একটি যুক্তি আছে। মানুষ নাকি এক পায়ে হাঁটে। হাঁটার সময় এক পা মাটিতে ভর দেয়, আরেক পা থাকে শূন্যে। এভাবে পায়ের পালাক্রমে হাঁটতে থাকে মানুষ। কিন্তু এখনকার গল্পটা ভিন্ন। ১১ বছরের কিশোর পল্লব কুমার কর্মকার। তার একটি পা আছে। চলার জন্য তার দুই পায়ের পালাক্রম লাগে না। এক পা তার শক্তি। তার সঙ্গে আছে মনবল। এটুকু নিয়ে সব প্রতিবন্ধকতাকে ঝেড়ে ফেলে সেরা সাঁতারু হতে চায় সে।
পল্লবের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের শিবতলা এলাকায়। সে ফতেপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। তার বাবা কাজল কর্মকার এবং মা শিউলী রানী কর্মকার।
দেশব্যাপী চলছে সাঁতারু অন্বেষণ প্রতিযোগিতা ‘সেরা সাঁতারুর খোঁজে বাংলাদেশ-২০১৬’। এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে পল্লব। প্রথম পর্বে নিজ জেলায় সেরা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বে বাছাইয়ে বিভাগ থেকে উত্তীর্ণ হয়েছে।
এখন সে অপেক্ষায় আছে বিদেশি প্রশিক্ষকের কাছে তিন মাসের প্রশিক্ষণ নেবে। এরপর বিশ্বমানের সাঁতারু হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের সুযোগ পাবে। এরপর সেরা চারজনের একজন হওয়ার স্বপ্ন দেখছে সে।
গতকাল বুধবার সকালে মিরপুরের সৈয়দ নজরুল ইসলাম জাতীয় সুইমিং কমপ্লেক্সে অনুষ্ঠিত এই প্রতিযোগিতায় পল্লবের সাফল্য অনেককেই মুগ্ধ করেছে। বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশনের সভাপতি ও নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদ অরুণের কাঁধে হাত রেখে ছবি তোলেন এবং তার সাফল্য কামনা করেন।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, এক পা না থাকার পরও পল্লব চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসে প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় পর্বে অংশগ্রহণ করে তার বিভাগে সফলতার সঙ্গে উন্নীত হয়েছে।
আইএসপিআর আরো জানায়, সাঁতারু অন্বেষণ প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় পর্ব বাছাইয়ে গতকাল ছিল তৃতীয় দিন। সকালে মিরপুরের সৈয়দ নজরুল ইসলাম জাতীয় সুইমিং কমপ্লেক্সে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এর আগে সারা দেশের ৬৪ জেলায় অনুষ্ঠিত প্রাথমিক বাছাই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এক হাজার ২৭৫ জন দ্বিতীয় পর্বে উন্নীত হয়। বয়সভিত্তিক চারটি ক্যাটাগরিতে ২৭৪ জন ছেলে এবং ৬৫ জন মেয়েসহ মোট ৩৩৯ জন সাঁতারু প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। এ সময় বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশনের সভাপতি ও নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদ ও সুইমিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মো. রফিজ উদ্দিন রফিজসহ নৌবাহিনীর অন্যান্য কর্মকর্তা ও বিপুলসংখ্যক দর্শক উপস্থিত ছিলেন।
দ্বিতীয় পর্বের বাছাইয়ে প্রতিযোগীদের শারীরিক কাঠামো, সাঁতারের স্টাইল এবং টাইমিং বিবেচনায় বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশনের নির্বাচন কমিটি তৃতীয় পর্বের জন্য বয়সভিত্তিক নারী ও পুরুষ মোট ১৬০ জন প্রতিযোগীকে মনোনীত করবে। তৃতীয় পর্বে মনোনীত এই ১৬০ জন প্রতিযোগীকে বিদেশি প্রশিক্ষকের মাধ্যমে তিন মাসব্যাপী নিবিড় প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। প্রশিক্ষণ শেষে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ১৬০ জনের মধ্যে সেরা ৬০ জন সাঁতারু নির্বাচন করা হবে। নির্বাচিত সেরা ৬০ জন সাঁতারুর প্রত্যেককে মেডেল, সার্টিফিকেট ও নগদ অর্থ পুরস্কার দেওয়া হবে।
সেরা ৬০ জন সাঁতারু বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশনে যোগ দিবেন এবং তাঁদের বিশ্বমানের সাঁতারু হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। প্রতিযোগিতায় বয়সভিত্তিক চারটি ইভেন্টের চূড়ান্তভাবে বিজয়ী সেরা চারজন নারী এবং চারজন পুরুষ সাঁতারুকে পাঁচ লাখ করে টাকা প্রদান করা হবে। সেরা এই সাঁতারুদের লেখাপড়ার ব্যবস্থাসহ যাবতীয় ব্যয়ভার সুইমিং ফেডারেশনের পক্ষ থেকে বহন করা হবে।
গতকাল রাতে পল্লবের বাবা কাজল কর্মকার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার ছেলের বয়স যখন তিন বছর তখন সে তার পা হারায়। তখন অগ্রহায়ণ মাস। ধান ওঠার সময়। ১৬০ মণ ধান নিয়ে একটি পাওয়ার টিলার পল্লবকে থেঁতলে দেয়। তার পায়ের মাংস ও রগ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ওই সময় তার বাঁচার আশা ছিল না। ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে তাকে দেড় মাস চিকিৎসা দেওয়া হয়।
পল্লবের সাঁতার শেখা সম্পর্কে কাজল কর্মকার আরো বলেন, ‘আমাদের গ্রামের বাড়ি ছিল শিবগঞ্জ থানার রানীহাটি বাজারে। সেখানে একটি পুকুরে সাঁতারে হাতেখড়ি পল্লবের। পরে আমরা চাঁপাইনবাবগঞ্জে বসবাস শুরু করি। গত পাঁচ মাস সে এখানকার সুইমিংপুলে সাঁতার শেখার সুযোগ পায়।’
উল্লেখ্য বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রতিভাবান সাঁতারুদের তুলে আনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশন ও নৌবাহিনীর যৌথ উদ্যোগে এ সাঁতারু অন্বেষণ প্রতিযোগিতা চলছে। পাঁচ মাসব্যাপী এর প্রাথমিক বাছাই কার্যক্রমে সারা দেশের ৬৪টি জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে প্রতিভাবান সাঁতারুরা অংশগ্রহণ করে। -কালের কন্ঠ।
২০ অক্টোবর, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম