চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে : চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মোবারকপুর ইউনিয়নের শিবনগর-ত্রিমোহনী গ্রামে নব্য জেএমবির ‘জঙ্গি আস্তানায়’ শুরু হওয়া সোয়াতের অপারেশন ঈগল হান্ট প্রায় ৪০ ঘণ্টা পর গতকাল সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
সোয়াতের অপারেশন চলাকালে নিজেদের বোমা বিস্ফোরণে রফিকুল ইসলাম আবু ওরফে আবুল কালাম আজাদ ওরফে আবুসহ চারজন নিহত হয়েছেন। নিহত আবু চাচরা গ্রামের আফসার আলীর ছেলে। সন্ধ্যায় প্রেস ব্রিফিংয়ে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি মো. খুরশিদ হোসেন। তবে নিহত অন্য তিনজনের নাম জানাতে পারেননি তিনি। নিহত আবুর স্ত্রী সুমাইয়া খাতুন তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা থাকায় তাকে ও তার শিশুকন্যা সাইদাকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধারের জন্য সোয়াত আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে সফল হয়েছে বলে দাবি করেছেন ডিআইজি খুরশিদ হোসেন।
তিনি বলেন, ‘অন্য অপারেশনের চেয়ে এটা আমরা সফলভাবে শেষ করতে পেরেছি। এ অভিযানে আমরা আবুর স্ত্রী ও মেয়েকে জীবিত বের করে আনতে সমর্থ হয়েছি।’ তারা হাসপাতালে চিকিৎপাধীন জানিয়ে এ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ভেতরে থাকা নারী ও শিশুদের কথা চিন্তা করে তাদের বারবার বের হয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে। সর্বশেষ বিকালেও মাইকিং করে তাদের বের হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
ডিআইজি খুরশিদ বলেন, ‘অপারেশন ঈগল হান্ট শেষ হলেও আগামীকাল সোয়াতের বোম্ব ডিসপোজাল টিম ও ক্রাইম সিন কাজ শুরু করবে। নিহতদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করা হবে। সব অপারেশন শেষ হলে প্রেস ব্রিফিংয়ে বিস্তারিত জানানো হবে।’ এর আগে সোয়াতের আহ্বানে জঙ্গি আবুর স্ত্রী সুমাইয়া খাতুন ও তার মেয়ে সাইদাকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে অ্যাম্বুলেন্সে করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সেখানে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। গণমাধ্যমকর্মীদের সেখানে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এদিকে অভিযান শেষ হলেও আশপাশ এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি রয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তা বলবৎ থাকবে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. শফিকুল ইসলাম। বুধবার সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে ‘অপারেশন ঈগল হান্ট’ নাম দিয়ে অভিযানটি শুরু হয় এবং রাত ৯টার দিকে তা স্থগিত ঘোষণা করেন সোয়াতের উপ-পুলিশ কমিশনার প্রলয় কুমার জোয়ারদার।
উপজেলার শিবনগর-ত্রিমোহনী গ্রামে আমবাগান ঘেরা ওই একতলা ওই বাড়িতে মাস তিনেক ধরে রফিকুল আলম আবু (৩০) নামের এক ব্যক্তি এবং তার স্ত্রী-সন্তানসহ চারজন থাকতেন বলে প্রাথমিকভাবে জানায় পুলিশ। তবে আবুর আরেক সন্তান তার নানির বাড়িতে রয়েছেন বলে অভিযানের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
সকাল থেকে মাইকে কয়েক দফা বলার পরও আত্মসমর্পণ না করায় বেলা সোয়া ৪টার দিকে ভেতরে থাকা দুই শিশুকে বের করে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। পরে বিকাল ৫টা থেকে সোয়া ৫টার মধ্যে আবুর স্ত্রী সুমাইয়া ও মেয়েকে বের করে হাসপাতাল পাঠানো হয়।
এর আগে শিবনগর-ত্রিমোহিনী এলাকায় মঙ্গলবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে সাইদুর রহমান জেন্টু হাজি নামে এক ব্যক্তির বাড়ি ঘেরাও করেন কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যরা। বাসাটি ঘিরে ফেলা হলে ভেতর থেকে গুলি ছোড়া হয়। পরে পুলিশও পাল্টা গুলি ছোড়ে। তবে সেখানে কী পরিমাণ বিস্ফোরক বা গোলাবারুদ ছিল সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পরে বুধবার ভোর ৬টার দিকে ওই বাড়ি থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়।
ওই দিন সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় আনুষ্ঠানিক অভিযান শুরু হয় এবং রাত ৯টায় তা স্থগিত ঘোষণা করা হয়। এর আগে অভিযান শুরুর সময় থেকে এক-আধ ঘণ্টা পর পর শোনা যায় মুহুর্মুহু গুলির শব্দ। সকাল ১০টা ০৬ মিনিটে একবার বিকট বিস্ফোরণ ঘটে। ‘অপারেশন ঈগল হান্ট’ নামে পরিচালিত এ অভিযান শুরুর আগেই সকাল ৮টার দিকে ঘটনাস্থলে মোতায়েন করা হয় অ্যাম্বুলেন্স ও ফায়ার সার্ভিস।
গতকাল সকাল সোয়া ৯টায় অভিযান শুরুর পর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সোয়াতের উপ-পুলিশ কমিশনার প্রলয় কুমার জোয়ারদার, রাজশাহী বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার নিসারুল আরিফ, জেলা পুলিশ সুপার টিএম মোজাম্মেল হক ঘটনাস্থলে পৌঁছান। বিকাল সোয়া ৫টার দিকেও ব্যাপক গুলির শব্দ এবং তিনটি গ্রেনেড বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। গণমাধ্যমকর্মীদের ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৫০০ গজ দূরে রাখা হয়। এলাকা এখনো পুলিশের কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে রয়েছে। ঘটনাস্থলে পুলিশের টিম দায়িত্ব পালন করছে।
কে এই আবু : শিবনগর-ত্রিমোহনী গ্রামে আমবাগানের মধ্যে একতলা ওই বাড়ির মালিক ৭৫ বছর বয়সী সাইদুর রহমান ওরফে জেন্টু বিশ্বাস। তিনি এলাকায় ধনী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। নিজে পরিবার নিয়ে পাশেই আরেকটি বাড়িতে থাকেন তিনি।
স্থানীয়রা জানান, মাস তিনেক আগে চাচরা গ্রামের দিনমজুর রফিকুল আলম আবুকে ভাড়া ছাড়াই ওই বাসায় থাকতে দেন জেন্টু বিশ্বাস। একসময় মাদ্রাসায় পড়া আবু একজন ভ্রাম্যমাণ মসলা বিক্রেতা। আট ও ছয় বছর বয়সী দুটি মেয়ে রয়েছে তার। ত্রিমোহনীর সেই বাড়ি মসলা ব্যবসায়ী পরিচয়ে ভাড়া নিয়েছিলেন আবু। মসলা ব্যবসায়ীর বাসায় যখন তখন অপরিচিত লোকজন আসতে থাকায় বাড়ির মালিকের সন্দেহ হয়, বিষয়টি জানানো হয় পুলিশকে।
ত্রিমোহনীর ওই বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে চাচরা গ্রামে আবুর বাবা-মা থাকেন। সকালে সাংবাদিকরা সেখানে গেলে আবুর মা ফুলছানা বেগমের সঙ্গে তাদের কথা হয়। তিনি বলেন, প্রায় ৯ বছর আগে সুমাইয়া খাতুনের সঙ্গে বিয়ের পর একই উপজেলার আব্বাস বাজারে শ্বশুরবাড়িতেই থাকতেন আবু। মাস তিনেক আগে তিনি জেন্টুর বাড়িতে ওঠেন।
মায়ের কথা রাখেননি আবু : মায়ের আহ্বানেও সাড়া দেননি আবু। এদিকে আজ সন্ধ্যায় তার মৃত্যুসংবাদ শুনে অজ্ঞান হয়ে পড়েন তার মা ফুলছানা বেগম। শিবনগর-ত্রিমোহনী গ্রামের ওই বাড়িতে যখন অবস্থান করছিলেন আবু, তার স্ত্রী ও শিশুকন্যা, তখন অপারেশন ঈগল হান্ট শুরুর আগে তার মা ফুলছানা বেগম ও চাচি চামেলী বেগমকে নিয়ে আসা হয় সেখানে। এ সময় ফুলছানা বেগম ছেলে আবুকে স্ত্রী ও মেয়েসহ বের হয়ে আসতে বলেন। কিন্তু মায়ের ডাকে সাড়া দেননি আবু। ফলে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান ফুলছানা বেগম। ওই সময় থেকেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
ফুলছানা বেগম জানান, ছেলের মৃত্যু হলেও বউ ও নাতনি বেঁচে যাওয়ায় তিনি কিছুটা হলেও স্বস্তি পেয়েছেন। তাদের দেখেই তিনি ছেলের স্মৃতি ধরে রাখবেন। নিহত আবু তার দুই কন্যাসন্তান রুনি ও সাইদাকে রেখে গেছেন। ফুলছানা তাদেরই মানুষ করবেন বলে জানান। বিডি প্রতিদিন
২৮ এপ্রিল ২০১৭/এমটি নিউজ২৪/এসবি