মহিউদ্দীন জুয়েল, চট্টগ্রাম থেকে : ঘূর্ণিঝড় মোরার খবর যখন টিভিতে প্রচার হচ্ছিলো তখন চট্টগ্রামের পতেঙ্গার সাগর পাড়ের বাসিন্দা মফিজুল হক (৭৫) ছিলেন ট্রলারে। বিকেল সাড়ে ৫টায় স্থানীয় লালদিয়ার চরের নিজ বাড়িতে ফেরার পর স্ত্রী রাবেয়ার মুখে পুরো বিষয়টি শুনে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে প্রথমে রাজি হননি সাগরে মাছ ধরে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করা এই মাঝি।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ইফতারের খানিক আগে যখন আশপাশের পরিবেশ ক্রমেই ভারী হয়ে উঠতে লাগলো তখন বাড়ির দক্ষিণ পাশের কড়ই গাছটি প্রবল বাতাসে হঠাৎ ভেঙে পড়ে। এই সময় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের মাইকিং টিম সবাইকে রাতের মধ্যেই আশ্রয় কেন্দ্রে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিতে শুরু করলে বাড়ির আশপাশের বাসিন্দারা সেখানে ছুটতে শুরু করেন।
রাত সাড়ে ১১টায় মফিজুল, তার স্ত্রী রাবেয়া, ৪ সন্তান নাজমুল, মনির, আকরাম, ইলিয়াস ও বাড়ির দুটো গরু নিয়ে দ্রুত ছুটে আসেন লালদিয়ার চরের ওই আশ্রয় কেন্দ্রে। সারারাত নির্ঘুম কাটিয়েছেন। ভোররাতে সেহেরি খেতে পারেননি।
পেকেট বিস্কুট খাইয়েছেন বাচ্চাদের। নিজে খেয়েছেন মুড়ি। তার স্ত্রী নিজে খেয়েছেন চিড়া। জানতে চাইলে মফিজুল বলেন, বাতাস দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। বাড়িতে কেউ নেই। সাগরের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাঁচি। ভয় পাই না। বাচ্চাগুলোর জন্য বাড়িতে থাকার সাহস পেলাম না।
রাত সাড়ে ৮টায় পার্শ্ববর্তী পতেঙ্গা বিমানবন্দর স্কুল আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে মোরার আঘাত থেকে বাঁচতে দলে দলে ছুটে আসছেন অন্তত ১০০ মানুষ। সবার বাড়িই চট্টগ্রামের পতেঙ্গার সাগর পাড়ের। বেশির ভাগ পরিবারের সদস্য ৬ থেকে ১০ জন করে। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে বাড়িতে থেকে মারা গেছেন আসলাম মিয়ার
দুই ভাই। তাই যখনই রোয়ানু, সিডর কিংবা নাডা এসেছে ততোবারই পরিবার পরিজন নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে ছুটে এসেছেন এই ব্যক্তি। মোরার খবর শুনে সন্ধ্যার পরপরই বাড়ির অসুস্থ মা, গরু-ছাগল আর অপর ৪ সদস্য নিয়ে রাতেই চলে আসেন এই ব্যক্তি। জানতে চাইলে আসলাম বলেন, ভোর রাতের সেহেরির জন্য কোন খাবার নিয়ে আসতে পারিনি। জেলা প্রশাসন আর কোস্টগার্ডের লোকজন খুব দ্রুত এলাকা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য চলে যেতে বলায় সবাই দ্রুত ছুটে এসেছি।
কেবল চট্টগ্রামের এই দুটো আশ্রয় কেন্দ্র নয়, ঘূর্ণিঝড় মোরার আঘাত থেকে বাঁচতে জেলার একাধিক আশ্রয় কেন্দ্রে গত সোমবার সন্ধ্যা থেকে ভোররাত পর্যন্ত ছিলো মানুষের ভিড়। যাদের বেশির ভাগই কাটিয়েছেন নির্ঘুম রাত। না খাইয়ে শুয়ে ছিলেন বেশির ভাগ মানুষ। কেউ পাটি বিছিয়ে, কেউ ফ্লোরে আবার কেউবা সারারাত হাটু গেড়ে বসেই পার করেছেন মারার আতংক। তবে সবচেয়ে বেশি ভিড় ছিলো চট্টগ্রামের পতেঙ্গা, আনোয়ারা, বাঁশখালী ও সীতাকুন্ডের আশ্রয় কেন্দ্রে।
মঙ্গলবার বিকেলে এই বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, এসব আশ্রয় কেন্দ্রে সর্বমোট একরাতেই এক লাখ ২০ হাজার ৫২০ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন বিভিন্ন স্কুলে।
মেরিন ফিশারীজ সার্ভিল্যান্স চেকপোস্ট আশ্রয় কেন্দ্রে আসা আমিনুল হক বলেন, অতীতে আশ্রয় কেন্দ্রে না এসে ভুল করেছি। এবার আর ভুল করতে চাই না। যেভাবে বাতাস হচ্ছে তাতে বড় গজব নেমে আসতে পারে। পতেঙ্গার লাল দিয়ার চর প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রটি প্রথমে তালা দেয়া ছিলো। পরে লোকজনের চাপে সেটি খুলে দেয়া হয়।
সেখানে আশ্রয় নেয়া আইয়ুব আলী বলেন, রাতে কিছু খাইনি। খাওয়ার চেয়ে জীবনটা বাঁচানো বড় চেষ্টা ছিলো। যদি সাগরের পানিতে জলোচ্ছ্বাস হতো তাহলো বড় ক্ষতি পারতো।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি সিটি মেয়র আজম নাছির উদ্দিন সরাসরি সাগর পাড়ের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি নিজে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে গিয়ে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছেন। এই বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি মানবজমিনকে বলেন, সন্ধ্যার পর পরিস্থিতি কিছুটা ভয়ানক হয়ে উঠলে সবাই দলে দলে আসতে থাকে। আমি কথা বলে যা দেখেছি তা হলো ভয় আর উদ্বেগ ছিলো তাদের। তবে আমরা চেষ্টা করেছি এসব মানুষদের জন্য কিছুটা খাবার, পানি আর থাকার জায়গার বন্দোবস্ত করতে।
৩১ মে, ২০১৭/এমটিনিউজ২৪ডটকম/এসবি