সারোয়ার সুমন ও সেকান্দর হোসাইন, চট্টগ্রাম থেকে: চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ত্রিপুরা পল্লীতে ছড়িয়ে পড়ছে অজ্ঞাত রোগ। নতুন করে এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এই রোগে গত সপ্তাহে নয় শিশু মারা গেছে।
শুক্রবার আরও ১৩ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এতদিন শুধু শিশু আক্রান্ত হলেও এখন এ রোগ ছড়িয়ে পড়ছে বয়স্কদের মাঝেও। ২০ ও ২২ বছর বয়সী দুই পুরুষ ও নারী আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ফৌজদারহাট বিআইটিআইডি-সংযুক্ত সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে।
অবস্থার অবনতি হওয়ায় এ হাসপাতাল থেকে ২০ জনকে শুক্রবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।
রক্ত, লালাসহ সংগৃহীত বিভিন্ন নমুনা পরীক্ষার প্রতিবেদন না আসায় চিকিৎসকরা এখনও এ রোগ সম্পর্কে অন্ধকারে আছেন।
এদিকে দুর্গম এ এলাকায় কেন কেউ টিকা গ্রহণ করেনি এবং কীভাবে নয় শিশুর মৃত্যু ঘটল, তা খতিয়ে দেখতে কাজ শুরু করেছে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. নাছির উদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘সীতাকুণ্ডের ত্রিপুরা পল্লীতে ছড়িয়ে পড়া রোগের কারণ এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। রোববারের মধ্যে ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার প্রতিবেদন হাতে পেলে রোগের প্রকৃত কারণও জানা যাবে। প্রাথমিকভাবে এখন অপুষ্টি ও জ্বরের চিকিৎসা করা হচ্ছে।’
ফৌজদারহাট বিআইটিআইডি-সংযুক্ত সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. মামুনুর রশীদ বলেন, ‘প্রতিদিন এ রোগে আক্রান্ত নতুন রোগী আসছে। আক্রান্তের তালিকায় সুমনবন্ধু ত্রিপুরা ও রানুবালা ত্রিপুরা নামে দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিও রয়েছেন।'
সীতাকুণ্ডে আক্রান্ত আরও ১৩ জন
চমেকে স্থানান্তর করা হয়েছে ২০ জনকে
ফৌজদারহাটের হাসপাতালে এখন মোট ৫৭ রোগী রয়েছেন। আর চমেক হাসপাতালে ছিল ১৪ জন। শুক্রবার এর সঙ্গে আরও ২০ জন যোগ হয়েছে। এর মধ্যে দু’জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ফৌজদারহাট থেকে স্থানান্তরিত হওয়া ২০ জনের মধ্যে তিন শিশুর অবস্থা আগের চেয়ে অবনতি হয়েছে। ফৌজদারহাট থেকে চমেকে স্থানান্তরিত হওয়া অন্যদের মধ্যে আছেন- সুমন ত্রিপুরা (২০), ইন্দ্রি ত্রিপুরা (১), যতীন্দ্র ত্রিপুরা (৭), স্বপ্না ত্রিপুরা (৪), খোকন ত্রিপুরা (৬), লুবনা ত্রিপুরা (৮), ঝর্ণা (৮), সোনারাম (৭), করিম বাবুল (৪), কবিতা (৩), সজল (৬), রীতা (৩), নৃত্যবালা (৭), রূপালী (২), রুপাবালা (৪), রঞ্জিত কুমার (২), মনুরঞ্জন (৫), সুমিতা (৭), দীপালী (৪)।
নতুন করে আক্রান্ত ১৩
নতুন করে আক্রান্ত ১৩ জনের মধ্যে সাতজন শুক্রবার সকালে ফৌজদারহাটের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তারা হচ্ছেন- সুবাস ত্রিপুরার ছেলে তৌফিক ত্রিপুরা (৪), শান্ত কুমার ত্রিপুরার ছেলে গীতাবাবু ত্রিপুরা (১৪), শীমুল (২), নীরঞ্জন ত্রিপুরার ছেলে হৃদয় (১৬), রিমন (৪), মানিক কুমার ত্রিপুরার ছেলে মধুকুমার ত্রিপুরা (৮) ও কম্বু ত্রিপুরার মেয়ে প্রভিলক্ষ্মী ত্রিপুরা (৬)। বিকেলে একই হাসপাতালে ভর্তি হয় আরও ছয় জন। তারা হচ্ছে- মুখমনি ত্রিপুরা (১১), নয়নমালা ত্রিপুরা (৯), অঞ্জনা ত্রিপুরা (৪), স্বপ্না ত্রিপুরা (৪), সুজন ত্রিপুরা (৮) ও সুমনবন্ধু ত্রিপুরা (২০)।
কাজ শুরু করেছে তদন্ত কমিটি
শিশু মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে গঠিত দুটি কমিটি শুক্রবার থেকে কাজ শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার রাতে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় এবং সীতাকুণ্ড উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটিগুলো গঠন করা হয়। মিরসরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. আবদুল খালেককে প্রধান করে গঠিত তদন্ত কমিটির তিন সদস্য শুক্রবার সকালে সোনাইছড়ির ত্রিপুরা পল্লীতে মারা যাওয়া শিশু পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন। এ ছাড়া পার্শ্ববর্তী এলাকা ও আক্রান্ত পরিবারের কাছ থেকে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেন।
ডা. মো. আবদুল খালেক বলেন, আগামী রোববার প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। শুক্রবার বিকেলে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন আজিজুর রহমান সিদ্দিকী ও ঢাকা থেকে আসা বিশেষজ্ঞ টিমও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে বলে জানিয়েছেন সীতাকুণ্ড উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এস এম রাশেদুল করিম।
খতিয়ে দেখা হচ্ছে টিকা না পাওয়ার কারণ
সারাদেশে সরকারি উদ্যোগে ১০টি রোগের জন্য শিশুদের টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ত্রিপুরাপল্লীর শিশুরা এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল। কখনও কোন টিকাকর্মী ওই এলাকায় যায়নি বলেও দাবি করেন এলাকার বাসিন্দারা। তবে বিষয়টি খতিয়ে দেখছে তদন্ত কমিটি
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থলে গিয়ে সব শিশুকে টিকার আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছেন।
এলাকার বাসিন্দা কম্বু ত্রিপুরা বলেন, ‘আমাদের এলাকায় শিশুদের কখনও টিকা দেওয়া হয়নি। টিকা বলতে কী বোঝায় তা আমরা জানি না।'
বিষয়টি সম্পর্কে ফৌজদারহাট সংযুক্ত সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে কর্তব্যরত শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মাহামুদ আল ফারাবী বলেন, ‘রোগে আক্রান্ত শিশুগুলোর পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা কোনো টিকা নেয়নি।'
তবে টিকা কার্যক্রম চালু আছে বলে দাবি করেন সীতাকণ্ড উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এসএম রাশেদুল করিম।
তিনি বলেন, ‘অনেকে টিকা নিতে চায় না। যেসব পরিবারের শিশুসন্তান রয়েছে টিকা দেওয়ার সময় তারা এলাকায় থাকে না। ত্রিপুরাপল্লীর অধিকাংশ মানুষ দিনমজুরি ও জুম চাষ করেন। তাদের পরিবারের নারীরাও জুম চাষে জড়িত। যার কারণে অনেকে শিশুদের টিকা দেয় না।-সমকাল
১৪ জুলাই ২০১৭/এমিটিনউজ২৪ডটকম/আ শি/এএস