গাজী ফিরোজ, চট্টগ্রাম থেকে: ঘুম থেকে জেগেই বুকটা ধক করে ওঠে নুসরাতের। বিছানায় নেই তাঁর নাড়িছেঁড়া ধন। ১১ মাস বয়সী মেয়েকে ঘরের কোথাও খুঁজে পেলেন না। সাতসকালে বেকার স্বামী ঘরে না থাকায় কেমন যেন সন্দেহ হয় তাঁর। দুপুরে ঘরে ফেরেন স্বামী আসলাম। মেয়ে কোথায়—পোশাকশ্রমিক স্ত্রীর এই প্রশ্নে ভীষণ রাগ করেন স্বামী। দাবি করেন, তিনি বের হওয়ার সময় শিশুটি ঘরেই ছিল। এভাবেই ঘটনার শুরু।
সেদিন ছিল ২৪ এপ্রিল। এরপর থেকে গত তিন মাস একটি মুহূর্তের জন্যও স্বস্তিতে ছিলেন না নুসরাত। একমাত্র সন্তান হাফছা মারজানকে দিনরাত পাগলের মতো খুঁজে ফিরেছেন তিনি।
চট্টগ্রাম নগরের হালিশহরের বাসিন্দা নুসরাত জাহান যখন সন্তানকে খুঁজে ফিরছেন, তখন আট কিলোমিটার দূরের দেওয়ানহাট এলাকার রাশেদা আক্তারের সংসারে আনন্দের বন্যা। তাঁর স্বামী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সেকান্দর কোথা থেকে একটি বাচ্চা ‘কুড়িয়ে’ পেয়েছেন। নিঃসন্তান এই দম্পতির খুশি অবশ্য বেশি দিন টিকল না। তিন মাস পর বেরিয়ে এল, শিশুটি কুড়িয়ে পাওয়া নয়। শিশুটিকে হারানোর আশঙ্কায় দুলে উঠল রাশেদার পৃথিবীও।
কয়েক দিন আগে নুসরাত জানতে পারেন, অন্য কেউ নয়, নেশাগ্রস্ত স্বামী ২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে নিজের সন্তানকে বিক্রি করে দিয়েছেন! এক নিঃসন্তান দম্পতির কাছে বড় হচ্ছে শিশুটি। সন্তানের খোঁজ পেয়ে গত মঙ্গলবার থানায় যান তিনি। মামলা করেন তাঁর স্বামী, পালক বাবাসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে। মামলার পর মঙ্গলবার বিকেলে পুলিশ শিশুটিকে উদ্ধার করে গতকাল আদালতে নিয়ে যায়। শিশুটিকে জিম্মায় পাওয়ার আবেদন নিয়ে আদালতে আসেন দুই মা-ও।
গতকাল বিকেলে আদালতে যখন শুনানি চলছিল, তখন এজলাসকক্ষে দাঁড়ানো দুই মা-ই অঝোরে কাঁদছিলেন। শুনানির সময় পালক মায়ের (রাশেদা) কোলে পরম নির্ভরতায় গলা জড়িয়ে ছিল শিশুটি। শুনানি শেষে চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম মেহনাজ রহমান আদেশ দেন, শিশুটি পাবেন গর্ভধারিণী মা। হারানো শিশুকে ফিরে পেয়ে নুসরাতের চোখে আনন্দের জল। অন্যদিকে শিশুটিকে আঁকড়ে ধরে তখন ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলেন রাশেদা।
পুলিশ ও আদালত সূত্র জানায়, হালিশহর এ ব্লক এলাকার পোশাকশ্রমিক নুসরাত জাহানের সঙ্গে মো. আসলামের তিন বছর আগে বিয়ে হয়। বিয়ের দুই বছর পর তাঁদের কন্যাসন্তান হয়। আসলাম স্ত্রীর কাছ থেকে নেশার টাকা না পেয়ে শিশুটিকে বিক্রি করে দেন। খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে নুসরাত মঙ্গলবার নিশ্চিত হন শিশুটিকে কিনেছেন দেওয়ানহাট এলাকার সেকান্দর-রাশেদা দম্পতি। প্রথমে রাশেদার বাড়িতে গিয়ে সন্তানকে ফেরত চান তিনি। কিন্তু তাঁরা দিতে অস্বীকৃতি জানালে চলে যান হালিশহর থানায়। মানব পাচার আইনে তিনি মামলা করার পরপরই নুসরাতের স্বামী আসলাম ও শিশুটিকে কিনে নেওয়া মো. সেকান্দরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মঙ্গলবার দুজনকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। বাদীর আপত্তি না থাকায় গতকাল সেকান্দরের জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন আদালত। তবে আসলামের পক্ষে আদালতে আইনজীবী ছিলেন না।
আদালত প্রাঙ্গণে শিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরে মা নুসরাত জাহান বলেন, ‘নেশার টাকার জন্য নিজের সন্তানকে বিক্রি করে দেয়, এমন বাবা যেন কারও না হয়।’ তিনি আসলামের শাস্তি দাবি করেন।
শিশুটিকে ফেরত দিয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকেন রাশেদা আক্তার। তিনি বলেন, এই তিন মাসে শিশুটি তাঁকে মা হিসেবে চিনেছে। তাঁকেই মা ডাকে। শিশুটিকে ছাড়া এখন কীভাবে থাকবেন ভাবতেও পারছেন না তিনি।-প্রথম আলো
এমটিনিউজ২৪ডটকম/টিটি/পিএস