কৃষ্ণ চন্দ্র দাস, সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম: অন্য আট-দশটা সাধারণ ছাত্রের মতো বেঞ্চে বসেই সমাপনী পরীক্ষা দিচ্ছে দুই হাত হারানো শিশু রফিকুল ইসলাম। তার বয়স ১৪ বছর। মুখে কলম কামড় দিয়ে ধরে মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষার খাতায় লিখে যাচ্ছে সে। চোখে-মুখে বুদ্ধিদীপ্ত ভাবটা তার স্পষ্ট। আরমান (১০) নামের এক ছেলে পাশে বসে খাতার পৃষ্ঠা উল্টিয়ে তাকে সহযোগিতা করছে। দুই বছর আগে এক দুর্ঘটনায় দুটি হাতই হারাতে হয়েছে এই ছাত্রকে। তবুও থেমে যায়নি রফিকুল। সব বাধা জয় করে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে সে।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী হাজী টিএসি উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে রোববার রফিকুল ইসলামকে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা দিতে দেখা যায়। আজ ছিল ইংরেজি পরীক্ষা। ভাটিয়ারী ইউনিয়নের পূর্ব হাসনাবাদ গ্রামের দিনমজুর বজলুর রহমানের ছেলে রফিকুল। তিন ভাইবোনের মধ্যে সে সবার বড়। সে ভাটিয়ারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র। পরীক্ষা শেষে কথা হয় অদম্য এই ছেলের সঙ্গে। রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলে, পরীক্ষায় তার সব প্রশ্ন কমন এসেছে। ভালো উত্তরও করে এসেছে। সব বাধা-বিপত্তি দূর করে ভবিষ্যতে সে উচ্চশিক্ষিত হয়ে মানুষের মতো মানুষ হতে চায়। তার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গাজী হুমায়ূন কবির প্রথম আলোকে বলেন, অন্য আট-দশটা ছেলের মতো তারও দুটি হাত ছিল। সে খুব ভালো ছাত্র। তিনি আশা করেন প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় সে খুবই ভালো ফল করবে।
রফিকুলের জীবনে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ দুর্ঘটনার কথা উল্লেখ করে শিক্ষক হুমায়ুন কবির বলেন, রফিকুল প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার্থী ছিল ২০১৬ সালে। ওই বছরের ৫ অক্টোবর ভাটিয়ারী বাজার এলাকায় পদচারী-সেতুর নির্মাণকাজ চলছিল। শ্রমিকেরা পুরো কাজ শেষ না করে সেতুটি খোলা রাখে। ওই দিন দুপুরে টিফিন পিরিয়ডে কিছু শিক্ষার্থী স্কুল থেকে বের হয়ে বাজারে যায়। রফিকুল পদচারী-সেতু খোলা পেয়ে পারাপারের সময় পাশে থাকা বিদ্যুৎ লাইনের সঙ্গে লেগে মারাত্মকভাবে দগ্ধ ও আহত হয়। পরে বিজয় সরণি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের রাশেদ নামের এক ছাত্র রফিকুলকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করেন।
রফিকুলের বাবা বজলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সেদিন দুর্ঘটনার পর তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েন। স্ত্রীকে নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে যান। কিন্তু তাঁর কাছে কোনো টাকাপয়সা ছিল না। পরে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নুরুচ্ছোফা তাঁকে পাঁচ হাজার টাকা দেন। এ ছাড়া বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও পাশের স্কুল-কলেজ থেকে কিছু সহযোগিতা আসে। সাজেদা আলম বিদ্যানিকেতনের চেয়ারম্যান বিশেষ সহযোগিতা করেন। সবার সহযোগিতা ও নিজের জমিজমা বিক্রি করে প্রায় ৯ লাখ টাকা খরচ করে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনেন ছেলেকে। চমেক বার্ন ইউনিটে ২ মাস ১৯ দিন ভর্তি ছিল রফিকুল।
বজলুর রহমান জানান, হাত দুটি কেটে ফেলার পর অনেক দিন কেঁদেছিল রফিকুল। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে সে। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর সে বই নিয়ে পড়তে বসতে চায়। কিন্তু লিখতে পারে না, বইয়ের পাতা উল্টাতে পারে না। এ জন্য হতাশায় কান্না করত। এই একটি পদচারী-সেতু তাঁর ছেলের সুন্দর স্বাভাবিক জীবন, সুন্দর ভবিষ্যৎ কেড়ে নিয়েছে।
শিক্ষক হুমায়ুন কবির বলেন, গত বছরের ৬ এপ্রিল প্রথম আলোতে ‘রায়হানের কাছে সবই তুচ্ছ’ শিরোনামে একটি সংবাদ ছাপা হয়। রায়হানের দুই হাত না থাকা সত্ত্বেও তিনি পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছেন। ওই সংবাদ পড়ে তিনি পত্রিকাটি রফিকুলের বাবা বজলুরকে দেন এবং রায়হানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। রায়হানের পুরো নাম বাহার উদ্দিন রায়হান। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের স্নাতক (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।
বাহার উদ্দিন রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ওই সংবাদটি পড়ে রফিকুলের বাবা তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি। পরে মুঠোফোনে যোগাযোগ হয় তাঁদের। পরে তিনি গিয়ে রফিকুলকে লেখাপড়ার জন্য উৎসাহিত করেন।
সীতাকুণ্ড উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নুরুচ্ছোফা প্রথম আলোকে বলেন, রফিকুল অত্যন্ত মেধাবী। তাকে দমিয়ে রাখা যাবে না। সে মুখ দিয়ে অন্য সাধারণ শিক্ষার্থীর মতো লিখতে পারে। তবুও নিয়ম অনুসারে পরীক্ষায় তাঁকে আধঘণ্টা সময় বেশি দেওয়া হয়েছে।
রফিকুলের বাবা বলেন, ‘ছেলেকে ভালো করতে সহায়-সম্পদের প্রায় সবটুকু বিক্রি করে দিয়েছি। খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে কীভাবে তাঁকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করব।’ এ জন্য সবার সহযোগিতাও প্রত্যাশা করেছেন তিনি।
সূত্র: প্রথম আলো