নিউজ ডেস্ক : কেঁচো খুড়তে গিয়ে বেরিয়ে আসছে সাপ। রোহিঙ্গা নারী লাকি আক্তারের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পাওয়া নিয়ে অনুসন্ধানে নেমে বেরিয়ে আসছে একের পর এক চমকপ্রদ তথ্য। পুরো ঘটনায় মধ্যমণি হয়ে কাজ করেছেন ডাবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসের অফিস সহায়ক মো. জয়নাল আবেদীন।
মামার জোরে বেপরোয়া জয়নাল : চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন অফিসের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গাদের এনআইডি পাইয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা পালন করা জয়নাল আবেদীন তার এক মামার মাধ্যমে ২০০৪ সালে নির্বাচন কমিশনে অফিস সহায়ক হিসেবে নিয়োগ পান। সেই বছরই দেড় কোটি ভুয়া ভোটার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার কারণে জয়নালের মামাকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করা হয়। কিন্তু নিজের মামা নির্বাচন কমিশনের বড় কর্তা হওয়ার সুবাদে দায়িত্ব পালনকালে অফিসে জয়নালের আচরণ ছিল বেপরোয়া।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন অফিসে দায়িত্ব পালনকালে অফিসে জয়নালের আচরণ ছিল উগ্র। এ কারণে বেশ কয়েকবার বিভিন্ন জেলায় শাস্তিমূলক বদলিও করা হয় তাকে। কিন্তু প্রতিবারই উচ্চ তদবিরে তিনি চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। সর্বশেষ তাকে বান্দরবানের থানচি নির্বাচন অফিসে বদলি করা হলেও তিনি পুনরায় নগরের ডবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসে বদলি হয়ে চলে আসেন।
নির্বাচন কমিশনে জয়নালের ১০ স্বজন : রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পাইয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা পালন করা জয়নাল আবেদীনের অন্তত ১০ স্বজন ঢাকা-চট্টগ্রামসহ নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন দফতরে চাকরি করছেন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন অফিসে অফিস সহায়ক পদে কর্মরত আছেন তার বোনের জামাই নূর মোহাম্মদ। নির্বাচন কমিশনের ঢাকা অফিসে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন জয়নালের স্বজন ওসমান গণী চৌধুরী, কক্সবাজার জেলা নির্বাচন অফিসে অফিস সহায়ক পদে কর্মরত আছেন জয়নালেন খালাতো ভাই মোজাফ্ফর। রাঙ্গামাটি জেলা নির্বাচন অফিসে উচ্চমান সহকারী হিসেবে কাজ করছেন জয়নালের আরেক স্বজন মোহাম্মদ আলী। এর মধ্যে কক্সবাজার নির্বাচন অফিসের অফিস সহায়ক মোজাফফর রোহিঙ্গাদের চট্টগ্রামে জয়নালের কাছে পাঠাতেন। চট্টগ্রামে নিয়ে আসতেন জয়নালের আরেক স্বজন জাফর ও তার আরেক সহযোগী নজিবুল আমিন।
জয়নালের সাব-এরিয়ার বাসা ছিল মিনি সার্ভার স্টেশন : চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন বলেন, রোহিঙ্গাদের এনআইডির জন্য চট্টগ্রামে থেকে ছবি, আঙুলের ছাপসহ প্রয়োজনীয় সব কিছু ডাবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসের অফিস সহায়ক মো. জয়নাল আবেদীন সরবরাহ করতেন। এক্ষেত্রে তিনি ছুটির দিনে অফিস থেকে নিয়ে আসা ওয়েবক্যাম, ফিঙ্গার প্রিন্ট নেয়ার যন্ত্র, স্ক্যানার, সিগনেচার প্যাড বাসায় ব্যবহার করতেন। জয়নালের চাকরি অফিস সহায়ক হলেও থাকতেন ফ্ল্যাট বাসায়। নগরের সাব-এরিয়া এলাকায় জয়নালের বাসা ছিল ‘মিনি সার্ভার স্টেশন’।
তিনি জানান, রোহিঙ্গাদের ভোটার করার কাজে তাকে তার স্ত্রী ছাড়াও সৈকত বড়ুয়া, শাহজামাল, পাভেল বড়ুয়া, বয়ান উদ্দিন নামের চার ব্যক্তি সহযোগিতা করতেন। তবে ডাটা ইনপুটের কাজ করতেন নির্বাচন কমিশনের সাবেক দুই কর্মচারী সাগর ও সত্যসুন্দর দে। রোহিঙ্গাদের জন্য প্রতিটি জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বানাতে জয়নাল ৫০-৬০ হাজার টাকা নিতেন।
জয়নাল বাসায় বসে থানা নির্বাচন অফিসের সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তৈরির প্রাথমিক কাজ করতেন। বর্তমানে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষে (বিআরটিএ) কর্মরত সাগর একসময় এনআইডি সার্ভারে আপলোডের কাজ করতেন। দেশের সব উপজেলার এনআইডি আপলোডের পাসওয়ার্ড জানার সুবাদে নির্বাচন কমিশনের সেন্ট্রাল সার্ভারে ডাটা ইনপুট দিতেন সাগর। একই কায়দায় জয়নালের সরবরাহ করা তথ্যে নির্বাচন কমিশনের সেন্ট্রাল সার্ভারে প্রবেশ করে রোহিঙ্গাদের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তৈরি করতেন সত্যসুন্দর। এই সত্যসুন্দর এর আগে এনআইডি সার্ভারে অনুপ্রবেশের জেরে নির্বাচন কমিশন থেকে চাকরিচ্যুত হন।
জয়নালের টাকার ভাগ পেত অনেকে : পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে জয়নাল জানিয়েছেন, এক বছরের বেশি সময় ধরে তিনি রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় নিবন্ধনের কাজ করছেন। অফিস সহকারী হলেও নির্বাচন কমিশনের লাইসেন্সধারী ল্যাপটপের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় নিবন্ধনের কাজ শুরু করেন ২০১৮ সাল থেকে।
নির্বাচন অফিসের আরও অনেকে এই কাণ্ডে জড়িত আছেন। ৫০-৬০ হাজার টাকার বিনিময়ে প্রতিটি রোহিঙ্গাকে ভোটার করা হতো। দালাল আর নির্বাচন অফিসের বিভিন্নজনকে দেয়ার পর একজন রোহিঙ্গাকে ভোটার করার বিনিময়ে জয়নাল পেতেন সাত হাজার টাকা।
জয়নাল জানিয়েছেন, নির্বাচন কমিশনের উচ্চমান সহকারী আবুল খায়ের তাকে এই পথে আনেন। নজিবুল্লা নামে একজন দালাল আবুল খায়েরের মাধ্যমে তার কাছে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসতেন। রোহিঙ্গাদের ভোটার করতে দালাল নজিবুল্লার কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিতেন আবুল খায়ের। তার সঙ্গে যুক্ত আছে কক্সবাজারের আরও অনেকে।
আবুল খায়ের ছাড়াও আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসের মোজাম্মেল, মিরসরাই নির্বাচন অফিসের অফিস সহকারী আনোয়ার, পাঁচলাইশ থানা নির্বাচন অফিসের হোসাইন পাটোয়ারি টেকনিক্যাল সাপোর্টার মোস্তফা ফারুক এসব কাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে দাবি করেছেন জয়নাল।
বাঁশখালীতে জয়নালের কোটি টাকার বাড়ি : পদবিতে নির্বাচন কমিশনের অফিস সহকারী হলেও জয়নালের হাত ছিল লম্বা। মামা নির্বাচন কমিশনের বড় কর্তা হওয়ায় জেলা অফিসের কর্মকর্তারাও তাকে এড়িয়ে চলতেন। রোহিঙ্গাদের এনআইডি তৈরি করে মাত্র কয়েক বছরে গ্রামে কয়েক কোটি টাকার বাড়ি করেছেন জয়নাল।
স্থানীয়রা জানান, বছর খানেক আগে বাঁশখালীর আশকারিয়া মাজার এলাকায় সাড়ে তিন গন্ডা জমি কেনেন জয়নাল। প্রতি গন্ডা ৬ লাখ টাকায় এ জমি কেনা হয়। সেখানে বর্তমানে পাঁচতলা ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে ভবনের তিনতলা পর্যন্ত নির্মাণকাজ।
প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পাইয়ে দেয়ার ঘটনায় সোমবার (১৬ সেপ্টেম্বর) রাতে চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন অফিসের কর্মচারী জয়নালসহ পাঁচজনকে আসামি করে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন ডাবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তা পল্লবী চাকমা। সূত্র : জাগোনিউজ২৪