শরিফুল হাসান: নয় মাস বয়সে বাবাকে শেষ দেখেছিল ছেলেটি। তার বোনের বয়স তখন ছয়। ৪৫ বছর ধরে নিখোঁজ বাবার স্মৃতি বলতে ছেলেটির সম্বল কয়েকটি ছবি। আর মেয়েটির আছে ঝাপসা স্মৃতি। তবে ওদের ৭৫ বছর বয়সী মায়ের কাছে স্বামীর স্মৃতি এখনো উজ্জ্বল। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর স্বামীর খোঁজটা অন্তত চান। মোহাম্মদ হানিফ আর নাইয়ার সুলতানা দীর্ঘদিন ধরে খুঁজছেন নিখোঁজ বাবা জার্মানির নাগরিক পিটার আইককে। বাংলাদেশে ব্যবসা করতে এসে পারিবারিকভাবে তাঁদের মা চাঁদ সুলতানার সঙ্গে পিটারের বিয়ে হয় ১৯৫৮ সালে। কিন্তু একাত্তরে নিখোঁজ হওয়ার পর ৪৫ বছরে আর খোঁজ মেলেনি পিটারের।
পিটার আইক জার্মান সেনাবাহিনীতে ছিলেন। চাকরি ছেড়ে ১৯৫৭ সালে বাংলাদেশে আসেন। চট্টগ্রাম বন্দরে ঠিকাদারি করার পাশাপাশি ব্যবসা করতেন। সেখানেই ব্যবসাসূত্রে জামালপুরের মোহাম্মদ তালুকদারের সঙ্গে পরিচয় হয়। একপর্যায়ে তালুকদারের ভাগনি চাঁদ সুলতানাকে বিয়ে করেন তিনি। এর আগে পিটার মুসলমান হন। তাঁর নতুন নাম হয় মো. ইউসুফ আইক। এই দম্পতি চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে বসবাস করতে শুরু করেন। তবে ব্যবসায়িক কাজে তিনি ১৯৭০ সালে স্ত্রীকে নিয়ে করাচি চলে যান। সেখানকার পার্সিয়ান হাউজিং সোসাইটির ১ নম্বর সড়কে থাকতেন। ১৯৭০ সালের ২২ মে খইয়াম সিনেমা হলের কাছে করাচির প্লাসা ক্লিনিকে জন্ম হয় হানিফের। কিছুদিন পর বাংলাদেশের পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ আঁচ করতে পারেন ইউসুফ আইক।
চাঁদ সুলতানা বলেন, যুদ্ধ শুরুর আগেই পিটার তাঁকে বলেন, তোমরা এখনই ছেলেমেয়ে নিয়ে জামালপুরে চলে যাও। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমি বাংলাদেশে আসব। ফেব্রুয়ারিতে তাঁরা দেশে আসেন। তখন হানিফের বয়স নয় মাস। যুদ্ধ শেষ হয়। অপেক্ষায় থাকেন চাঁদ সুলতানা। কিন্তু স্বামীর আর খোঁজ মেলে না। জামালপুরের আশেক মাহমুদ কলেজ থেকে ১৯৯৩ সালে ডিগ্রি পাস করে দুবাই চলে যান চাঁদ-পিটার দম্পতির ছেলে হানিফ। ২০০৮ সালে যান ফ্রান্সে। বিদেশের পাট চুকিয়ে ২০১১ সালে দেশে এসে স্থায়ী হন। ২০১৫ সালে তিনি মনস্থির করেন, এবার বাবাকে খুঁজে বের করবেনই। শুরু হয় হানিফের নতুন লড়াই। হানিফ বলেন, ২০১৫ সালের ২২ ডিসেম্বর ঢাকার জার্মান দূতাবাসে বাবার খোঁজে চিঠি লেখেন। জার্মান দূতাবাস থেকে ৫ জানুয়ারি দেওয়া জবাবে বলা হয়, তৃতীয় কোনো ব্যক্তির কাছে তারা জার্মানির কোনো নাগরিকের তথ্য দেবে না। এর বদলে জার্মানির জন্মনিবন্ধন অফিসে পিটারের খোঁজ করতে বলা হয়। পরে আরেক চিঠিতে বলা হয়, প্রয়োজনে হানিফ জার্মানির পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে পারেন। তবে এ জন্য হানিফকে প্রমাণ করতে হবে, তিনি পিটারের ছেলে। বিয়ের কাবিননামাও দেখাতে হবে।
হানিফ জানান, মায়ের সঙ্গে কথা বলে তিনি জানতে পারেন কাবিননামা, গয়নাগাটি সবকিছুই পাকিস্তানে ছিল। কারণ, তাঁর মা ভেবেছিলেন, কিছুদিন পরেই আবার স্বামীর কাছে ফিরবেন। তবে তাঁর মা জানিয়েছেন, তাঁদের বিয়ে হয়েছিল ময়মনসিংহের গুলকীবাড়ীতে। যে কাজি বিয়ে পড়িয়েছিলেন, তাঁর খোঁজ করে জানতে পারেন, ওই কাজি মারা গেছেন। আর ১৯৫৮ সালের কাবিননামাগুলো যুদ্ধে পুড়ে গেছে। হতাশ হন হানিফ। চাঁদ সুলতানার মামাতো ভাই সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা লে. কর্নেল জালালউদ্দিন বলেন, ‘আইক আর সুলতানার বিয়েতে আমি উপস্থিত ছিলাম। তখন আমি স্কুলে পড়ি। বিয়ের পর চট্টগ্রামে ওদের বাড়িতেও গিয়েছি অনেকবার। ১৯৬৭ সালে আমি সেনাবাহিনীতে যোগ দিই। ওরা পাকিস্তানে চলে আসার পরও দেখা হয়েছে। ১৯৭০ সালের আগস্ট মাসেও করাচিতে আইকের সঙ্গে আমার অনেকক্ষণ আড্ডা হয়েছে। পরে আর খোঁজ পাইনি।’
এর মধ্যে ঘটে অন্য এক ঘটনা। জামালপুরে হানিফকে দেখতে পেয়ে একদিন এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক প্রশ্ন করেন, ‘তুমি কি পিটার আইকের ছেলে? কারণ, তুমি দেখতে পিটারের মতোই।’ ওই ভদ্রলোক নিজেকে মোহাম্মদ হাকিম বলে পরিচয় দেন। তিনি জানান, চট্টগ্রামের এ কে খান কোম্পানিতে লেদার শাখার ব্যবস্থাপক ছিলেন। তাঁর বস ছিলেন জার্মানের নাগরিক মিরকো সিকাস। তাঁর সঙ্গে পিটার আইকের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। চট্টগ্রামে তাঁরা অনেক দিন একসঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন। চট্টগ্রামের জার্মান দূতাবাসের কনস্যুলার হেরাল্ড ফিক্সও তাতে যোগ দিতেন। ফিক্সের ছেলে গিডোকেও তিনি চেনেন।
হাকিম বলেন, ‘পিটার আইকের সঙ্গে চাঁদের বিয়ের পুরো ঘটনা আমি জানি। দিনের পর দিন একসঙ্গে আড্ডা দিয়েছি। সিকাস আর আইক খুব ভালো বন্ধু ছিলেন। ফিক্স সেখানে আসতেন। আমি মনে করি, ফিক্সের খোঁজ পেলেই পিটারের খোঁজ মিলবে।’ জার্মান দূতাবাসের কর্মকর্তা ফিক্সের সঙ্গে তাঁর বাবার ঘনিষ্ঠতার খবরে আশাবাদী হয়ে ওঠেন হানিফ। এ বছরের ২৩ জানুয়ারি আবার তিনি জার্মান দূতাবাসে চিঠি দেন। তাতে বলেন, চট্টগ্রামের জার্মান কনস্যুলার হেরাল্ড ফিক্সের সঙ্গে তাঁর বাবার যোগাযোগ ছিল। কাজেই হেরাল্ডকে খুঁজে পেলে বাবার খোঁজ পাবেন। কিন্তু দূতাবাস থেকে বলা হয়, প্রয়োজনে তিনি জার্মানির পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে পারেন।
হতাশ কণ্ঠে হানিফ বলেন, ‘আমি ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ পৃথিবীর ১৭টা দেশ ঘুরেছি। আর্থিকভাবে আমি সচ্ছল। আমার জার্মানিতে যাওয়ার, থাকার কিংবা নাগরিকত্ব নেওয়ার ইচ্ছা নেই। আমি শুধু বাবার খোঁজ চাই।’ বোন নাইয়ার সুলতানা বলেন, ‘আমরা তো বাবাকে দেখিনি। বাবার পরিবারের কারও খোঁজ পেলে প্রয়োজনে ডিএনএ টেস্ট করাতাম। জার্মানির কাছে, বাংলাদেশ সরকারের কাছে, জার্মানপ্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে সহায়তা চাই।’ বৃদ্ধা চাঁদ সুলতানা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার এক যুগের সংসার ছিল পিটারের সঙ্গে। মৃত্যুর আগে যদি স্বামীর খোঁজটা পেতাম। বেঁচে না থাকুক, যদি কবরটা দেখতে পেতাম...।-প্রথম আলো
২৯ মে,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ