বৃহস্পতিবার, ৩০ জুন, ২০১৬, ০১:৪৯:৫৯

মিতু হত্যা, আসলে দায়ী কে?

মিতু হত্যা, আসলে দায়ী কে?

চিররঞ্জন সরকার: যেখানে যাই সবার একই প্রশ্ন, চট্টগ্রামের আলোচিত মাহমুদা খানম মিতু হত্যার ঘটনাটি আসলে কে ঘটিয়েছে? সত্যিই কী এই খুনের সঙ্গে বাবুল আক্তার জড়িত? বলা যায়, এই প্রশ্নের উত্তর এখন পুরো জাতি খুঁজছে। কিন্তু কেউই পাচ্ছে না। এদিকে প্রতিদিনই নতুন মোড় নিচ্ছে মিতু হত্যার তদন্ত। পুলিশের সর্বশেষ দাবি, চাঞ্চল্যকর এই খুনের সঙ্গে এখন পর্যন্ত কোনো উগ্রপন্থির যোগসূত্র পাওয়া যায়নি। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে মনে করা হচ্ছে ব্যক্তিগত বিরোধের জেরেই খুন করা হয়েছে মিতুকে। হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে এরই মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে ছয়জনকে। উদ্ধার করা হয়েছে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র।

চাঞ্চল্যকর মিতু হত্যাকাণ্ড নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহটা ব্যাপক হয় গভীর রাতে মিতুর স্বামী এসপি বাবুল আক্তারকে বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে ১৫ ঘণ্টা ‘জিজ্ঞাসাবাদ’ এবং এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে এমন ইঙ্গিতে কিছু গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার ঘটনায়। এর ফলে বেড়েছে  গুঞ্জন। প্রতিদিনই নানা রকম প্রশ্ন উঠছে পত্রপত্রিকার প্রতিবেদনে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। বরং দিনকে দিন ঘনীভূত হচ্ছে হত্যারহস্য। খুনের পরপরই পুলিশ বলেছিল, মিতু হত্যার সঙ্গে জঙ্গিরা জড়িত। এরপর দেশব্যাপী চালানো হয় জঙ্গিবিরোধী বিশেষ অভিযান। প্রথম চারদিনে আটক করা হয় ১১ হাজারের বেশি মানুষকে। কিন্তু এ বিষয়ে এখন স্বয়ং পুলিশ প্রধান একেএম শহীদুল হক বলছেন, মিতু হত্যায় জঙ্গি সম্পৃক্ততার বিষয়টি এখনও নিশ্চিত নয়! তবে স্বস্তির ব্যাপার হলো, এই অভিযানের পর এখন পর্যন্ত চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা আর ঘটেনি!

ইতিমধ্যে মিতু হত্যার ঘটনায় আটক করা হয়েছে ছয়জনকে, উদ্ধার করা হয়েছে হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রও। আটকদের মধ্যে এসপি বাবুল আক্তারের কথিত ‘দুই সোর্স’ আবু মুছা ও এহতেশামুল হক ভোলা রয়েছে। আর এই মুছা ও ভোলাকেই খুনের মূল হোতা বলে দাবি করেছে পুলিশ। এছাড়া আরো আটক রয়েছে ওয়াসিম, রাশেদ, আরিফ ও রিপন নামের চার যুবক। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়: গ্রেফতার হওয়া দুই যুবক ওয়াসিম ও আনোয়ার মিতু হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। তারা জানিয়েছে, মুসা নামে এক পরিচিত ব্যক্তির নির্দেশে তারা এ ঘটনায় জড়িয়েছে।

মধ্যরাতে বাবুলকে কেন ডেকে নিয়ে যাওয়া হলো, এই ডেকে নিয়ে যাওয়ায় ঘটনাটি মিডিয়ায় কীভাবে এলো, দীর্ঘ ১৫ ঘণ্টা ধরে তাকে কী জিজ্ঞাসা করা হলো, এই দীর্ঘ সময় মোবাইল ফোন কেন বন্ধ রাখা হলো, কেন পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন করে রাখা হলো-এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। এদিকে জিজ্ঞাসাবাদের পর থেকে এসপি বাবুল আক্তার নাকি আর বাসা থেকে বের হননি। যাননি কর্মস্থলেও, কথা বলেননি গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে। বাবুল বর্তমানে অবস্থান করছেন তার শ্বশুরবাড়ি রাজধানীর খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়া ভূঁইয়াপাড়ায়। সেখানে নাকি পুলিশ পাহারা বাড়ানো হয়েছে। কেউ বলছেন, নিরাপত্তার জন্য এই পুলিশ, কেউ বলছেন, আসলে নজরদারিতে রাখার জন্যই এই পাহারা! কোনটা সত্যি-কেউ জানে না! জানতে পারছে না।

সর্বশেষ ঘটনা সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এ হত্যাকাণ্ডে বাবুল আক্তার জড়িত কি না, সে প্রসঙ্গ এখনো আসেনি, তিনি (এসপি) নজরদারিতে নাই । কিন্তু প্রশ্ন হলো, তা হলে তার সঙ্গে কেন আসামির মতো আচরণ করা হচ্ছে? এদিকে প্রথম আলো পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, ‘বাবুলকে ডিবি কার্যালয়ে আনার পর এক উপ-কমিশনারের কক্ষে ডিআইজি পদমর্যাদার তিনজন কর্মকর্তা জিজ্ঞাসাবাদ করেন। ওই সময় তাকে দুটি শর্ত দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। বলা হয়, ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার সব তথ্য-প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে। তাকে জেলে যেতে হবে অথবা বাহিনী থেকে সরে যেতে হবে। বাহিনী থেকে সরে যাওয়ার ব্যাপারে বাবুল সম্মতি দেন বলে জানা গেছে।’

পুরো বিষয়টি বহু প্রশ্নের জন্ম দেয়। বাবুল আখতারই কী তবে স্ত্রীকে খুন করেছেন? তাহলে প্রশ্ন আসে, কোন শিক্ষিত বাবা তার ছেলের সামনে মাকে হত্যা করতে পারে? দুটো ছোট ছোট ছেলেমেয়ে থাকা অবস্থায় কেউ কি এই ধরনের খুনের পরিকল্পনা মাথায় আনতে পারে? অনেকে এ প্রশ্নও তুলেছেন যে, পুলিশ যদি বাবুল আখতারকে বাঁচাতেই চাইতো তাহলে অপরাধীদের ‘ক্রসফায়ার’ করতো। বাবুল যদি খুনের ঘটনার সঙ্গে সত্যি সত্যি জড়িত থাকেন তবে ফৌজদারি আইনে এবং পুলিশের বিভাগীয় আইনে শাস্তি পাবেন। কিন্তু যখনই তাকে বলা হচ্ছে শুধু পুলিশ বাহিনী থেকে সরে যেতে তখনি সন্দেহ হচ্ছে আসলে এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা! প্রশ্ন আরও আছে, এই ধরনের খুনের পর অর্থাৎ কেউ স্ত্রী হত্যা করে শ্বশুরবাড়ি উঠে কী?

নাকি সবই ষড়যন্ত্র, তিনি অপপ্রচারের শিকার? বাবুল আক্তারের প্রতি যাদের অগাধ আস্থা, তারা (শ্বশুরসহ) বলছেন, পুলিশ বাহিনীতে তার ‘সাফল্য ও বীরত্বে’ ঈর্ষাকাতর সহকর্মীদের কারও কারও ষড়যন্ত্রের শিকার তিনি। পুলিশ বাহিনীতে পেশাগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা কি সত্যিই এ রকম পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে? নাকি দলীয় আনুগত্যের বিচারে কোনো বিভাজন রয়েছে, যার প্রভাব পড়ছে বাহিনীর দৈনন্দিন কাজকর্মে? পুরো বিষয়টি ঘিরেই শুধু প্রশ্ন আর প্রশ্ন। কিন্তু কোনো প্রশ্নের জবাব নেই। পত্রপত্রিকায় আটক ব্যক্তিদের জবানবন্দি ছাপানো হলো, তারা মিতুকে খুন করেছে-এমন স্বীকারোক্তির কথা বলা হলো। কিন্তু কার নির্দেশে তারা এটা করলো-সে খবর পাওয়া গেল না! ঘটনার দিন এসপির বাসায় পুলিশ পাহারা ছিল না কেন তার জবাব নাই। প্রতিদিন একজন পুলিশ সদস্য নাকি আসতো বাচ্চাটিকে বাসে তুলে দিতে। শুধু ঐ দিনই এসপির স্ত্রী আসে নিজে বাচ্চা দিতে। খুনিরা আগে থেকে কি করে জানলো যে ঐ দিন পুলিশ সদস্য আসবে না, আসবে এসপির স্ত্রী? স্ত্রীর জন্য বাবুলের বুক ফাটা কান্না কি তাহলে মিথ্যা? অভিনয়?

এসব প্রশ্নেরও কোনো জবাব মিলছে না। কিন্তু এসব প্রশ্নের জবাব পেতে হবে। ন্যায়বিচারের আশায় সারাদেশের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। সবাই চাইছে মিতু হত্যা-রহস্য দ্রুত উদঘাটিত হোক। বাবুল আক্তারের স্ত্রীর হত্যার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, হত্যাকারীদের ছাড়া হবে না। আশা করি এটা প্রধানমন্ত্রীর কথার কথা নয়। এখন আমরা বাস্তবে প্রধানমন্ত্রীর কথার প্রতিফলন দেখতে চাই। হত্যার পরিকল্পনাকারীসহ কেউ যেন ছাড় না পায়। অনতিবিলম্বে এই হত্যারহস্য উদঘাটন করে উদ্বিগ্ন জাতিকে স্বস্তি প্রদান করুন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করুন-মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এটাই প্রত্যাশা।- চ্যানেল আই অনলাইন

৩০ জুন,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে