শনিবার, ৩০ জুলাই, ২০১৬, ০২:৫৯:৫৬

‘ওই টাকা তুই ব্যবস্থা করে দিবি, না হলে তোকে মেরে ফেলব’

‘ওই টাকা তুই ব্যবস্থা করে দিবি, না হলে তোকে মেরে ফেলব’

বখতিয়ার হোসেন বকুল: বাবা-মা হারিয়েছেন খুব ছোটবেলায়। দশ ভাই ও এক বোনের সংসারে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। দিনমজুরের কাজ করে কোনো রকম চলছিল সংসার, আর একটু ভালো থাকার আশায় স্থানীয় আদম ব্যাপারির সহায়তায় ইরাকে যান দামুড়হুদা উপজেলার জগন্নাথপুরের মনিরুল ইসলাম মনির।

ভালোও থাকা তো দূরের কথা, বেঁচে থাকা এখন তার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে নোয়াখালীর এক দালালের হাতে বন্দি থেকে নির্মম নির্যাতন সইছেন তিনি। ইতিমধ্যেই তার দশটি দাঁত ভেঙে দেওয়া হয়েছে; উপড়ে ফেলা হয়েছে সাত আঙুলের নখ।

সারা শরীরে নির্যাতনের অসংখ্য ক্ষত। এমন মধ্যযুগীয় নির্যাতনের চিত্র ধারণ করে পাঠানো হয়েছে তার পরিবারের কাছে। ২১ লাখ টাকা না দিলে তাকে মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এ ঘটনায় আদালতে আদম ব্যাপারি সবুরসহ পাঁচজনের নামে মামলা হয়েছে। অসহায় পরিবারের সদস্যরা এ বিষয়ে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।


এদিকে মনিরকে মুক্ত করে আনার কথা বলে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয়রা বলছেন, উপজেলার নাতুদাহ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা ইয়াছনবী 'নাটের গুরু'। সে-ই পেছনে থেকে সবকিছু করছেন। তাকে ধরতে পারলেই মনির মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে আসবেন।

তবে ওই আওয়ামী লীগ নেতা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, 'আমি সাহায্য করতে চেয়েছিলাম; কোনো ক্ষতি করিনি। ওই পরিবারের সদস্যরা আমাকে অন্যায়ভাবে দোষারোপ করছেন।' টাকা নেওয়ার কথা বলা হলে তিনি বলেন, '৫ থেকে ৭ জন লোক ঢাকায় নিয়ে গেলে কিছু টাকা তো খরচ হবেই।'

মামলার এজাহার ও এলাকাবাসীর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, মনিরুল ইসলাম মনির জগন্নাথপুর গ্রামের মৃত ভিকু শেখের ছেলে। মোটা বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে তার কাছ থেকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে চার লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় একই গ্রামের তেতুল মণ্ডলের ছেলে সবুর।

মাস দুয়েক আগে সে মনিরকে ইরাকে নিয়ে যায়। ওখানে পেঁৗছানোর পর সবুর মনিরকে ইরাকে অবস্থানরত দালাল নোয়াখালী এলাকার জসিমের হাতে তুলে দেয়। এরপর সে কৌশলে বাড়ি ফিরে আসে। এরপর জসিম মনিরকে বলে, 'সবুরের কাছে ভিসা বাবদ ২১ লাখ টাকা পাব। তোকে আমার জিম্মায় রেখে গেছে। ওই টাকা তুই ব্যবস্থা করে দিবি। না হলে তোকে মেরে ফেলব।'

এরপর থেকেই টাকার জন্য জসিম তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালাতে থাকে। দাঁত ভেঙে দেওয়ার পাশাপাশি চাবুক দিয়ে পিটিয়ে তার শরীর ক্ষতবিক্ষত করা হয়। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মনির বিষয়টি তার ভাইদের জানান।

এই কথা জানার পরই তারা ছুটে যায় সবুরের বাড়ি। সবুর মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে কৌশলে এলাকা ত্যাগ করে। অবস্থা বুঝে তেতুল মণ্ডলও বাড়িঘরে তালা লাগিয়ে সপরিবারে পালিয়ে যায়।

মনিরের পরিবারের সদস্যরা জানান, তাকে জীবিত ফিরে পেতে সহায়সম্বল বিক্রি করে ৭ লাখ টাকা ওই দালালের কাছে পাঠানো হয়। এরপর আরও ১১ লাখ টাকা দাবি করা হয়। টাকা না পেয়ে বাড়িয়ে দেয় নির্যাতনের মাত্রা। এরপর উপড়ে ফেলা হয় আঙুলের নখ। নির্যাতনের দৃশ্য পাঠানোর পাশাপাশি কয়েক দফায় ফোনে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।

এ সময় 'সাহায্যের হাত' বাড়ান ইয়াছনবী। তিনি মনিরের পরিবারকে বলেন, 'ঢাকায় আমার পরিচিত ওসি আছে। আমি ওই ওসিকে দিয়ে নোয়াখালী থেকে জসিমের বাবাকে ধরে এনে তার মুক্তির ব্যবস্থা করব।' দিশেহারা মনিরের পরিবার ওই নেতার কথায় ধারদেনা করে লক্ষাধিক টাকা তুলে দেয় তার হাতে।

ইয়াছনবী ১১ জুলাই জগন্নাথপুরের মোস্তফা, ইন্নাল শেখ, আনোয়ার ও মনিরের ভাই ইমরোজকে সঙ্গে করে ঢাকায় যান। মিরপুরের প্রিন্স হোটেলে রাত যাপন শেষে পরদিন তারা বাড়ি ফিরে যান। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না।'

মনিরের ভাই ইমরোজ বলেন, 'আমি ইয়াছনবীর হাতে ৭৪ হাজার টাকা তুলে দিই। এ ছাড়া মাইক্রো ভাড়া বাবাদ ১৮ হাজার টাকা, হোটেল ভাড়া বাবদ ৬ হাজার টাকা, খাওয়া খরচ বাবদ ৩ হাজার টাকাসহ সর্বমোট ১ লাখ ১ হাজার টাকা ওই দুই দিনে খরচ হয়।'

দামুড়হুদা মডেল থানার ওসি আবু জিহাদ বলেন, 'মনিরের ভাই বুলবুলের দায়ের করা মামলাটি গত বৃহস্পতিবার নিয়মিত মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে।' ইয়াছনবীর গ্রেফতারের বিষয়ে তিনি বলেন, 'মামলায় তাকে আসামি না করায় তাকে এখন গ্রেফতার করা যাবে না।

তবে এলাকার লোকজন তার বিষয়ে মৌখিকভাবে অভিযোগ জানিয়েছেন। আমরা সেগুলো খতিয়ে দেখছি। সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেলেই তাকে গ্রেফতার করা হবে।' চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার রশীদুল হাসান বলেন, 'বিষয়টি মানবিক। আমরা তদন্ত করে দেখছি। তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'-সমকাল

৩০জুলাই,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে