সরওয়ার আলম শাহীন : মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ও সে দেশের পুলিশের নির্যাতন চলছেই। পাশপাশি চলছে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত পয়েন্টগুলো দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ। সে দেশে পুরুষদের পাশাপাশি পাশবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে যুবতীসহ অসংখ্য নারী, পাষণ্ডদের নির্যাতন থেকে বাদ যাচ্ছে না অবুঝ শিশুরাও।
বাধাহীন মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে সেদেশে। মানবিক বিপর্যয়ের এক জ্বলন্ত জাহান্নামে পরিণত হয়েছে রোহিঙ্গাদের বসতভিটে। এমন নির্মমতায় প্রাণ হারাচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী। সর্বস্ব হারিয়ে নিজেদের প্রাণটুকু বাঁচানোর তাগিদে তারা পাড়ি জমাচ্ছে বাংলাদেশে। রোহিঙ্গা বস্তিতে অবস্থান নিয়ে তারা কাঁদছে, তাদের সঙ্গে সঙ্গে কাঁদছে মানবতা। কিন্ত বস্তির বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গাদের উপর সরকারের নিযন্ত্রণ না থাকার কারণে এলাকায় চুরি, ডাকাতি, জঙ্গি তৎপরতা, সন্ত্রাসী ও অপরাধমূলক কার্যক্রমও বাড়ছে বলে সচেতন মহলের অভিযোগ। এসব রোহিঙ্গাকে নিয়ন্ত্রণ জরুরি বলেও তাদের অভিমত।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা কক্সবাজার ও বান্দরবানের প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ উখিয়া ও টেকনাফের ২টি নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এবং বস্তিতে বসবাস করছে ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। ১৯৭৮ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারে ৩ দফায় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এদেশে আশ্রয় নিয়েছে তারা। ১৯৭৮ সালে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ফাত্রাঝিড়ি বিজিবি (তৎকালীন বিডিআর) ক্যাম্পে মিয়ানমারের তৎকালীন নাসাকা বাহিনী ক্যাম্পে লুট করে অস্ত্র ও গোলা বারুদ নিয়ে যায়। সে সময় নিহত হয় একজন বিজিবি (বিডিআর) সদস্য।
তখন রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর চরম নির্যাতনের অজুহাত তুলে ৩ লাখের অধিক রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে। দু’দেশের কূটনৈতিক পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনার পর পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি মোতাবেক ২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে যায়। বেশির ভাগ রোহিঙ্গা ফেরত গেলেও লক্ষাধিক রোহিঙ্গা এদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়ে যায়। এরপর ১৯৯১ সালের নভেম্বর মাসের দিকে আবারো নির্যাতনে অজুহাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় ২ লাখ ৬৫ হাজার রোহিঙ্গা। উখিয়া, টেকনাফ, নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায় ২০টি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়।
সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতায় ২০০৫ পর্যন্ত ধাপে ধাপে বেশির ভাগ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় মিয়ানমারে ফেরত গেলেও রেজিস্ট্রার্ড শরণার্থী ক্যাম্পে আটকা পড়ে প্রায় সাড়ে ৩২ হাজার রোহিঙ্গা। ২০১২ সালে ফের নির্যাতনের শিকার হয়ে দেড় লক্ষাধিক রোহিঙ্গার আগমন ঘটে। তারা বর্তমানে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তি ও টেকনাফের মুছনি, নয়াপাড়া এবং শাপলাপুর বস্তি এলাকায় ঝুঁপড়িঘর নির্মাণ করে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বসবাস করছে। এসব রোহিঙ্গারা খুন, রাহাজানি, ছিনতাই, ডাকাতি, চাদাবাঁজি, ইয়াবা ও মানবপাচারে, জঙ্গি তৎপরতার সাথে জড়িত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
বিভিন্ন সময় থানা পুলিশের হাতে রোহিঙ্গাদের অনেকেই আটক হয়েছে। মামলা হয়েছে বেশকিছু রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে। এমনতিইে বস্তিতে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ নেই, তার উপর ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর আবারো মিযানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর দমন, নিপীড়ন, অত্যাচার চালায় মিযানমার সেনাবাহিনী পুলিশ। যে কারণে প্রাণ বাঁচাতে ১১ই নভেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ২০ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তিতে এবং টেকনাফের মুছনি ও লেদা বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে।
এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আশ্রয় নিয়েছে আরো অসংখ্যা অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা নাগরিক। সীমান্ত বিভিন্ন পয়েন্টে উখিয়া, টেকনাফ অঞ্চলে দায়িত্বরত বিজিবি সদস্যরা প্রতিদিন নাফ নদীতে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা ফেরত দিলে স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে সীমান্তের চোরাই পথ দিয়ে রোহিঙ্গারা স্ব-পরিবারে ঠিকই অনুপ্রবেশ করছে। বিজিবি’র তথ্য মতে গত একমাসে উখিয়া-টেকনাফের বিজিবি সদস্যরা ২৫৭৮ জন অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা নাগরিককে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
এ সময় অনুপ্রবেশ করে বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে ২০ হাজারেরও অধিক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু। সরকারিভাবে এসব রোহিঙ্গাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা না হলেও বিভিন্ন এনজিও সংস্থা ও ব্যক্তি উদ্যোগে অত্যান্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করছে। এনজিও সংস্থা আইওএম’র প্রোগ্রাম ম্যানেজার সৈকত বিশ্বাস স্বীকার করে বলেন, তারা ৩শ’ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের খাদ্য তৈরির সরঞ্জামাদি সরবরাহ করেছে।
সুজনের সভাপতি নূর মুহাম্মদ সিকদার জানান, প্রায় দেড় লক্ষাধিক রোহিঙ্গার ভারে নুইয়ে পড়া জনপদ উখিয়ার সাধারণ মানুষ তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এ অবস্থায় আরো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত থাকলে এলাকার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হবে। বস্তিসহ অনুপ্রবেশকৃত রোহিঙ্গা নিয়ন্ত্রণ জরুরি বলে তিনি মনে করেন। আর তা হলে অভাবের তাড়নায় এসব রোহিঙ্গারা অপরামূলক কর্মকাণ্ডে জড়াবে এটাই স্বাভাবিক।
উখিয়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী জানান, অনুপ্রবেশ প্রতিরোধে বিজিবি, পুলিশ, কোস্টগার্ডসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর থাকার পরও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। এ অবস্থায় এসব রোহিঙ্গাকে ত্রাণসামগ্রী দিয়ে সহযোগিতা করা হলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে উৎসাহিত করা হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়।
এ ব্যাপারে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাঈন উদ্দিনের যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, অনুপ্রবেশকৃত রোহিঙ্গা ও বস্তির রোহিঙ্গাদের উপর কড়া নজরদারী রাখা হয়েছে, তারা যাতে বস্তির বাইরে যেতে না পারে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এমজমিন
১০ ডিসেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসবি