মঙ্গলবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৭, ০১:৪১:২২

নাগরিকত্ব পেলে মিয়ানমারে ফিরতে চায় রোহিঙ্গা শরণার্থীরা

নাগরিকত্ব পেলে মিয়ানমারে ফিরতে চায় রোহিঙ্গা শরণার্থীরা

সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার থেকে : নিরাপত্তা ও নাগরিকত্ব পেলে মিয়ানমার ফিরে যেতে চান বলে জানিয়েছেন কুতুপালং শরণার্থী শিবির আশ্রয় নেয়া নির্যাতিত রোহিঙ্গারা। সোমবার রাখাইন কমিশন দ্বিতীয় দিনের মতো ক্যাম্প পরিদর্শনে আসার পর তাদের কাছে এসব কথা জানান রাখাইন রাজ্যের নিপীড়িতরা।

কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম নোমান বলেন, মিয়ানমার সরকারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচি গঠিত রাখাইন অ্যাডভাইজরি কমিশনের সদস্যরা দ্বিতীয় দিনের মতো সোমবার বেলা ১০টার দিকে উখিয়ার কুতুপালং শরনাথী ক্যাম্প পরিদর্শনে আসেন।

রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারে সেনা-পুলিশের নিপীড়নের শিকার গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত জামবুনিয়ার আমির হোসেন, দুই ছেলেমেয়েকে হারিয়ে চলে আসা মুহাম্মদ জহুর, স্ত্রী ও মেয়ের নির্মম হত্যার দৃশ্য দেখে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া হোসেন আহমদসহ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ৪০ নারী, ১৮ শিশু ও ১২জন পুরুষের সঙ্গে কথা বলেন কমিশন সদস্যরা।

এসময় তাদের কাছ থেকেও নিজ দেশে নির্যাতনের বর্ণনা মনোযোগ দিয়ে শুনেন তারা। ক্যাম্প সূত্র আরো জানায়, রেজিস্ট্রার ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে কমিশন সদস্যরা অনিবন্ধিত ক্যাম্পের বিভিন্ন অলিগলি ঘুরে বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলেছেন।

এসময় তাদের ভবিষ্যত চাওয়া সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে আশ্রিত রোহিঙ্গারা বলেছেন, নিজ দেশেই তারা ফিরে যেতে চান। তবে, নাগরিকত্ব নিয়েই তারা স্বাধীনভাবে দেশে ফেরার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

তাদের দাবি, মিয়ানমারে ১৪৭ জাতের মধ্যে রোহিঙ্গা ছাড়া বাকি সবার নাগরিকত্ব রয়েছে। তাই নিজ জন্মভূমি হলেও পরবাসীর মতোই জীবন কাটাতে হয় রোহিঙ্গা মুসলিমদের। পরিবারের পুরুষ সদস্যদের কাজে লাগিয়ে পারিশ্রমিক দেয়া হয় না।

তাদের এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কোন কথা বলতে গেলে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এরই ধারাবাহিকতায় পুলিশ ক্যাম্পে দূর্বৃত্ত হামলার সূত্র ধরে রোহিঙ্গাদের ভোগদখলীয় জমি দখল, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, হত্যা-গুম ও নারীদের সম্ভ্রমহানি করে অবর্ননীয় নির্যাতন করা হচ্ছে। তাই জীবন বাঁচাতে তারা সীমান্তবর্তী বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন।

আশ্রয় পেলেও বাংলাদেশে তারা থেকে যেতে চান না। নাগরিক মর্যাদা পেলে তারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মিয়ানমার ফিরে যেতে চান। এটি নিশ্চিত করতে তারা কমিশন সদস্যদের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেন।

এসময় ক্যাম্প এলাকায় নানা পেস্টুনসহ লাইনে দাঁড়িয়ে নিজেদের দাবি দাওয়া তুলে ধরেন নির্যাতিত রোহিঙ্গারা। শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে বেলা ২টার দিকে জেলা প্রশাসনের সাথে বৈঠক করেন রাখাইন কমিশনের সদস্যরা। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে প্রায় ঘন্টাব্যাপী রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন তারা।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বৈঠকের সত্যতা স্বীকার করে জানান, রাখাইন কমিশনের সদস্য মিয়ানমারের নাগরিক উইন ম্রা, আই লুইন এবং লেবাননের নাগরিক ঘাসান সালামেসহ আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম), জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন (ইউএনএইচসিআর) ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা সোমবার সকালে দ্বিতীয় দিনের মতো উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে যান। সেখান থেকে ফিরে জেলা প্রশাসকের অফিস কক্ষে বিশেষ সভায় মিলিত তারা।

তিনি আরো জানান, বৈঠকে রাখাইন কমিশন সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে মিয়ানমারের বিভিন্ন অভিযোগ ও দাবি সম্পর্কে জানতে চান। যুক্তিতে মিয়ানমারের অভিযোগ ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করে দেয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক রাখাইন স্টেটে সংগঠিত ঘটনায় বাংলাদেশী জড়িত বলে মিয়ানমারের দাবিকে কল্পকাহিনী বলে জানানো হয়েছে।

তিনি বলেন, কারণ, মিয়ানমারের চেয়ে আমাদের জীবনযাত্রা অনেক উন্নত। তাই সেখানে আমাদের এখানকার কেউ যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। রোহিঙ্গারা আমাদের দেশে অবস্থান গেড়েছেন এমন প্রমাণ অহরহ রয়েছে, কিন্তু মিয়ানমারে আমাদের কোন বাংলাদেশী আবাস গেড়েছে এমন কোন প্রমাণ তারা দেখাতে পারবে না।  

জেলা প্রশাসক বলেন, সীমান্তে মাদক পাচার, অনুপ্রবেশসহ আরো অনেক বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। কথা হয়েছে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অবস্থান সংখ্যা নিয়েও। পূর্ব এবং সাম্প্রতিক সময়ে কী পরিমাণ রোহিঙ্গা এসেছে তা এখন নিশ্চিত করে বলা না যাচ্ছে না। তবে শীঘ্রই এ সংখ্যা নিরুপণের চেষ্টা চলছে বলে প্রতিনিধি দলকে জানানো হয়েছে।

আর পরিদর্শন ও বৈঠকের আলোচনাসহ সব বিষয় এক করে প্রতিনিধিদল শীঘ্রই একটি প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। বৈঠকে বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি), জেলা পুলিশের প্রতিনিধি, জাতিসংঘ ও অন্যান্য বিদেশি সংস্থার কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

প্রসঙ্গত, গত ৯ অক্টোবর বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সে দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বেশ কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা হয়। এতে মায়ানমার সীমান্ত পুলিশের ১২ সদস্য নিহত হয়। এ হামলার জন্য রোহিঙ্গা মুসলমানদের দায়ী করে নির্যাতন চালায় মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। তাদের নির্যাতনে শতাধিক রোহিঙ্গা মুসলমান নিহত হয়েছে।

জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এরই প্রেক্ষিতে গত শনিবার রাখাইন কমিশনের তিন সদস্য ঢাকায় পৌঁছান। সেখান থেকে রোববার তারা কক্সবাজার এসে উখিয়ার বালুখালী ও টেকনাফের লেদা ক্যাম্প ঘুরে দেখেন।

সোমবার সকালে পুনরায় কুতুপালং ক্যাম্প ঘুরে দেখে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকের পর বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে প্রতিনিধিদল ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন। ৩১ জানুয়ারি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রতিনিধিদল বৈঠক করবেন বলে কথা রয়েছে।  -ইত্তেফাক
৩১ জানুয়ারি ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে