মঙ্গলবার, ২৯ আগস্ট, ২০১৭, ০৯:০৫:৩৮

‘মিয়ানমারের সেনারা হিংস্র প্রাণীর চেয়েও জঘন্য’

‘মিয়ানমারের সেনারা হিংস্র প্রাণীর চেয়েও জঘন্য’

কক্সবাজার: সীমান্তের জিরো পয়েন্টের কড়া সতর্ক প্রহরায় এপারে (বিজিবি) বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ; ওপারে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) মুহুর্মুহু টানা গুলিবর্ষণের শব্দ। আর সীমান্ত এলাকায় হাজার হাজার স্বজন ও সহায়সম্বলহারা আশ্রয়হীন রোহিঙ্গাদের আর্তনাদ। এদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু, যারা অসহায়ের মতো এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। বাড়িঘর, স্বজন, সহায়সম্বল সব হারিয়ে শুধু প্রাণ বাঁচাতেই ছুটছে তারা। যে যে ভাবে পারছে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে এই প্রতিবেদকের নজর কাড়ে দুই মাস বয়সী কন্যাসন্তান কোলে নিয়ে বসে থাকা রশিদা বেগম (২৩) নামে মহিলা।

তিনি প্রায় দশ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে পৌঁছেছেন গত রোববার বিকেলে। ঘন জঙ্গলে হিংস্র প্রাণীর বিপৎসঙ্কুল পরিবেশের তোয়াক্কা না করে বাড়িঘর, স্বজন, সহায়সম্বল সব হারিয়ে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে ছুটে এসেছেন। আসার সময় উঁচুনিচু পাহাড় থেকে বার দুয়েক গড়িয়ে পড়লেও হামাগুড়ি দিয়ে আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন। রোববার নাফ নদীর জিরো পয়েন্টে তার সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। হিংস্র প্রাণীতে ভরা ঘন জঙ্গল ভেদ করে রাতদিন হেঁটে বাংলাদেশে কেন ছুটে এসেছেন?

জবাবে রশিদা জানিয়েছেন, ‘পাহাড়ের হিংস্র প্রাণীর চেয়েও বেশি হিংস্র হলো মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তারা আমাদেরকে পাখির মতো গুলি করে মারছে। যাকে যেখানে পাচ্ছে সেখানে ধারাল অস্ত্র দিয়ে কোপাচ্ছে। নারী, শিশু ও বৃদ্ধ কেউ বাদ যাচ্ছেন না। যুবকদের পেলে তো কথাই নেই। আমার স্বামী বেঁচে আছেন কি মরে গেছেন তা জানি না।’

আর্তনাদ করে রশিদা আরো বলেন, ‘আমরা বাঁচতে চাই। আমাদের রক্ষা করুন। আমাদের সাহায্য করুন।’

আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গারা নিছক বেঁচে থাকার আশা নিয়ে বাংলাদেশের দিকে ছুটে আসছেন প্রতিদিন। শুধু রশিদা নন, তার মতো শত শত নারী, শিশু ও বয়োবৃদ্ধ মানুষ সীমান্তে খোলা আকাশের নিচে ‘আমাদেরকে বাঁচাও বাঁচাও’ বলে আর্তনাদ করছেন। তারা জানেন না তাদের পুরুষদের ভাগ্যে কী ঘটেছে। শুধু পরনের কাপড় ছাড়া কোনো সহায়সম্বল নেই। তবে কারো কারো হাতে সুটকেস, বস্তা, থলে ও হাঁড়িপাতিল দেখা গেছে। এদের অনেকে শুক্রবার পৌঁছেছে সীমান্তে। আবার অনেকে শনি- রোববারে।

হাতে ধরে গণনা করা না গেলেও ধারণা করা হচ্ছে, লক্ষাধিক রোহিঙ্গার স্রোত বাংলাদেশের দিকে। তারা এক দিকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মুহুর্মুহু গুলির শব্দে আঁতকে উঠছে, অন্য দিকে বাংলাদেশের বর্ডার গার্ড (বিজিবি) তাদের ঢুকতে না দেয়ার ব্যাপারে অনড় অবস্থানে সতর্ক প্রহরায় রয়েছে। খোলা আকাশের নিচে, নাফ নদীকূলে কেওড়াবাগান ও ঝোপজঙ্গলে চরম মানবেতরভাবে অবস্থান করছে এসব আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গা।

এ দিকে দুর্গম পথ পাড়ি দেয়া আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গারা অনাহারে থাকায় শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন। খেতে না পেয়ে শিশুদের চিৎকার আর কান্নায় ভারী হয়ে উঠছে সীমান্তের জিরো পয়েন্টের পরিবেশ। নিজেরা না খেতে পেয়ে শিশুদের বুকের দুধও দিতে পারছেন না রোহিঙ্গা মায়েরা।

এই রকম ১০ দিন বয়সের আর এক শিশু কোলে নিয়ে বসে আছেন মোহছেনা বেগম, বয়স ২০ বছর। বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন মিয়ানমারের মংডু ঢেঁকিবুনিয়ায় বাড়ি। স্বামীর নাম রুহুল আমিন (২৪)। মোহছেনা মাত্র ১০ দিন বয়সের তার কন্যাশিশুকে কোলে নিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি বর্তমানে ঘুমধুম জলপাইতলী সীমান্ত পয়েন্টে অন্যান্য রোহিঙ্গার সাথে অবস্থান করছেন। বাংলাদেশে ঢোকার পর তার একমাত্র দুশ্চিন্তা কোলের শিশুটিকে তিনি কিভাবে বাঁচিয়ে রাখবেন? মোহছেনার মতো অসংখ্য নারীই এখন সীমান্তের বাসিন্দা হয়েছেন।

রোববার বিকেলে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইবুনিয়া সীমান্ত পয়েন্টে বিজিবির পাহারায় জটলা বেঁধে বসে আছে শত শত রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু।

কুলছুমা বেগম (৩৫) জানান, তার বাড়ি মিয়ানমার আরাকান রাজ্যের ঢেঁকিবুনিয়া গ্রামে। দুই ছেলে তিন মেয়ের মধ্যে এক ছেলেকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে সে দেশের সেনাবাহিনী। সে আর ফিরবে না। তাই তারা প্রাণের ভয়ে বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন।

ছবি আরা বেগম নামে আরেক নারী কাঁদতে কাঁদতে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে গিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর একটি দল হত্যা করেছে। আমাকেও তারা পশুর মতো করে নির্যাতন করেছে। এ কারণে আমি বাংলাদেশে পালিয়ে এসে সীমান্তে আশ্রয় নিয়েছি। তাদের মতো হাজারও মোহছেনা, কুলছুমা আর ছবি আরা বেগম এখন খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছে জলপাইবনিয়ার মতো পুরো সীমান্তজুড়ে।
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে