নিউজ ডেস্ক : প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত অতিক্রম করে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা এক মুঠো খাবারের জন্য হাহাকার করছে। আহত ব্যক্তিরা চিকিৎসার অভাবে কাতরাচ্ছে। চারদিকে কান্নার রোল আর হাহাকার। আর কত কষ্ট সহ্য করতে পাচ্ছে না তারা। স্থানীয়দের মতে, রোহিঙ্গারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে, পালিয়ে আসা এসব মানুষের জন্য প্রয়োজন খাদ্য ও পানীয় এবং চিকিৎসা সুবিধা। এখনই সেসবের জোগান নিশ্চিত না হলে সংকট হঠাৎ করেই মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।
পালিয়ে আসা নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা রাত কাটাচ্ছেন আশ্রয় কেন্দ্রের বাইরে খোলা আকাশের নিচে। সেখানেও অনেকের জায়গা না মেলায় তারা শয্যা নিয়েছেন সড়কের উপর। এরা সহায়-সম্বল রেখে প্রাণ বাঁচাতে এদেশে আশ্রয় নিলেও এমনিতেই মিয়ানমারে (তাদের ভাষায়) চতুর্মুখী হামলায় দিশেহারা। উপরন্ত অর্ধাহারে, অনাহারে সহায় সম্পদ ফেলে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও পেঠের ক্ষুধায় বিশেষ করে শিশু এবং বৃদ্ধরা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এইসব রোহিঙ্গা এখন খোলা আকাশের নিচে। সঙ্গী হয়েছে রোদ আর বৃষ্টি। নলকূপের পানিই তাদের একমাত্র ভরসা হয়ে উঠেছে।
সেই সঙ্গে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিগত সহিংসতার শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আশা রোহিঙ্গারা আশ্রয়ের খোঁজে পাহাড়-সমতল ও রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন।
কিন্তু এই ভাবে কতক্ষণ বা কতদিন। খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নেয়ায় একদিকে রোদ বৃষ্টি বয়ে যাচ্ছে মাথার উপর দিয়ে। অন্যদিকে আহত ব্যক্তিরা চিকিৎসার অভাবে কাতরাচ্ছে। চারদিকে কান্নার রোল আর হাহাকার। আর কত কষ্ট সহ্য করতে হবে তার কোনো সীমানা নেই। তবে সব কষ্ট সহ্য করা গেলেও খোদার জ্বালা কিভাবে কত দিন।
ইউএনএইচসিআরের বাংলাদেশ অফিসের মুখপাত্র জোসেফ ত্রিপুরা বলেন, নিবন্ধিত ক্যাম্পে আসা রোহিঙ্গাদেরকে সীমিত আকারে তাবু, খাদ্য ও ঔষধ দেয়া হয়েছে। অনিবন্ধিত ক্যাম্পে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে খাদ্য, ওষুধ ও পানির সংকট বেশি। কুতুপালং অনিবন্ধিত ক্যাম্পের স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ আনোয়ার জানান, ক্যাম্পে খাদ্য ও পানির সংকট বাড়ছে, দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া না হলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে।
মিয়ানমারের আরকান রাজ্যে গত ২৫ আগস্টে নতুন করে সেনা অভিযান শুরুর পর থেকে গত ১০ দিনে দেড় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাদের প্রতিবেদনে ১ লাখ ২৩ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢোকার কথা বললেও বাস্তবে এর সংখ্যা দেড় লাখ ছাড়িয়েছে বলে স্থানীয় সূত্র দাবি করেছে।
জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর কর্মকর্তা ভিভিয়েন ট্যান বলছেন, আর গত ২৫ আগস্ট থেকে মোটের উপরে ১ লাখ ২৩ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে ঠাঁই নিয়েছে। জনবহুল বাংলাদেশে এর আগেও ৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সীমান্ত এলাকার এক জনপ্রতিনিধি বলেন, ঈদের দিন ঘুমধুম সীমান্তে জাফর-আয়েশা দম্পতি মিয়ানমার সেনাদের গুলিতে খুন হওয়ার পরই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে। প্রতিটি সীমান্ত দিয়ে দলে দলে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকছে। শিশু-বৃদ্ধদের কোলে-কাঁধে করে নিয়ে আসছে তারা। যেসব সীমান্তে বিজিবির কড়া অবস্থান রয়েছে সেখানের জিরো পয়েন্টে অবস্থান করছে রোহিঙ্গা। রাতে কিংবা বৃষ্টিতে যে যার সুযোগ মতো বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে।
কুতুপালং ও বালুখালী এবং লেদা রোহিঙ্গা বস্তি নিয়ন্ত্রণকারী মাঝিদের দাবি, তাদের একেক বস্তিতে নতুন করে ৫০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। নতুন করে আরো কয়েকটি বস্তি গড়ে তোলা হয়েছে। সব মিলে নতুন করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা দেড় লাখের বেশি।
কুতুপালং অনিবন্ধিত ক্যাম্পের মাঝি আবু ছিদ্দিক ও মুহাম্মদ নূর বলেন, আমাদের ক্যাম্পে গত ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত অর্ধ লাখেরও বেশি নতুন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশপাশে আশ্রয় নিয়েছে। বলতে গেলে এর সংখ্যা ৬০-৭০ হাজারের কম নয়। পুরনো যে দুটো রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির- কুতুপালং এবং নয়াপাড়ায় টালে তিল ধারণের ঠাঁই নেই।
বালুখালী ক্যাম্পের মাঝি ইলিয়াছ ও ছৈয়দ নূর জানান, তাদের ক্যাম্প ও আশপাশ এলাকায় নতুন করে অর্ধলাখ রোহিঙ্গা খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছে। যে যেভাবে পারছে, যেখানে পাচ্ছে সেখানেই আশ্রয় নিচ্ছে। যখন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে এসব ক্যাম্পে আসে তখন তাদের তাড়িয়ে দেয়ার সুযোগ থাকে না বলেও জানান তারা।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, গত কয়েকদিন আশঙ্কাজনকহারে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকেছে। ঠিক কত সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে এর সংখ্যা এক লাখের বেশি। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হলেও তা সঠিক নয়। আসলে মূল হিসেব এর চাইতেও বেশি। এমনকি মিয়ানমারের জুলাই থেকে শুরু হওয়া দমন অভিযানের কারণে ঠিক কতো মানুষ বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে তাও পরিস্কার করে বলা মুশকিল! সংখ্যাটা স্বাভাবিকভাবেই অনেক অনেক বেশি।
সু চিকে এরদোগানের ফোন : রোহিঙ্গাদের নিয়ে পুরো মুসলিম বিশ্ব উদ্বিগ্ন
বিবিসি জানায়, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইপ এরদোগান মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সূচিকে ফোন করে রোহিঙ্গা মুসলিমদের 'মানবাধিকার লঙ্ঘন' নিয়ে উদ্বেগ এবং নিন্দা জানিয়েছেন।
গত সপ্তাহে বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে 'গণহত্যা' চলছে।
আর মঙ্গলবার এরদোগান সরাসরি ফোন করেছেন মিয়ানমারের সবচেয়ে ক্ষমতাবান রাজনৈতিক নেত্রী অং সান সূ চিকে।
বার্তা সংস্থা এএফপি এবং রয়টার্স প্রেসিডেন্টের মুখপাত্রদের উদ্ধৃত করে জানাচ্ছে, ফোনালাপে এরদোগান সু চির কাছে রোহিঙ্গা মুসলিমদের 'মানবাধিকার লঙ্ঘন' নিয়ে উদ্বেগ এবং নিন্দা জানিয়েছেন।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট সু চিকে বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট পুরো মুসলিম বিশ্বের জন্য গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে।
তিনি বলেন, "নিরপরাধ মানুষের ওপর সন্ত্রাসীর তৎপরতার নিন্দা করছে তুরস্ক। মিয়ানমারে যে মানবিক সঙ্কট তৈরি হয়েছে সেটি উদ্বেগ এবং ক্ষোভের বিষয়।" সূ চির উত্তর বা প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কিছু জানা যায়নি।
তুরস্কের সরকারি বার্তা সংস্থা আনাদলু জানিয়েছে, রোহিঙ্গা পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে এবং কথা বলতে প্রেসিডেন্ট এরদোগান তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভুসোগলুকে বুধবার বাংলাদেশের পাঠাচ্ছেন।
রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে তুরস্ক বিশেষ তৎপর হয়ে উঠেছে।
ঈদের ছুটির সময় প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এই সঙ্কট নিয়ে বিভিন্ন মুসলিম দেশের নেতাদের সাথে টেলিফোনে কথা বলেছেন। এমনকি জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব অন্তোনিও গুতেরেজের সাথেও কথা বলেছেন তিনি।
তুরস্কের নেতা বলেছেন, এ মাসের শেষে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের সভায় তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুটি তুলবেন।
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস