আমানুর রহমান রনি, কক্সবাজার থেকে: নূর বিবি। চোখ মুখ থেকে এখনও কৈশোরের ছাপ মোছেনি। ১৫ বছর বয়সেই বিয়ে হয় তার। দু’বছরের মাথাতেই হন অন্তঃসত্ত্বা। সংসার ভালোই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন রাতে জ্বলে ওঠে গ্রাম। স্বামীর পরিবারের সঙ্গে অজানা গন্তব্যে পা বাড়ান নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা নূর বিবি। অবশেষে পাহাড় জঙ্গল ডিঙ্গিয়ে যখন সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশের উখিয়ার বালুখালী পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছেন, ততদিনে পার হয়ে গেছে আরও ১৩ দিন। আশ্রয় নেওয়া সেই পাহাড়ের চূড়ায় হঠাৎ শুরু হয় প্রসব বেদনা। তারপর নূর বিবির অন্ধকার চোখ আলো করে ভূমিষ্ঠ হলো এক ফুটফুটে কন্যা।
এটি এক রোহিঙ্গা কিশোরীর প্রথম মা হওয়ার কষ্টগাঁথা। সোমবার (৪ সেপ্টেম্বর) রাতের ঘটনা এটি, সেদিনই মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ঢুকে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলেন এ রোহিঙ্গা দম্পতি। বৃহস্পতিবার (৮ সেপ্টেম্বর) দুপুরে বালুখালী পাহাড়ের চূড়ায় সদ্য জন্ম নেওয়া মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বসে থাকতে দেখা যায় প্রথমবারের মতো মা হওয়া নূর বিবিকে। ফুটফুটে সন্তানের কপালে দেখা যায় শুভ কামনার তিলক লাগানো চন্দন গুড়ার ফোঁটা। তবে প্রথম মা হওয়ার আনন্দ স্পর্শ করতে পারছে না নূর বিবিকে। কারণ তার মা-বাবাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একই সময় সবাই বাড়ি থেকে বের হলেও তারা কোথায় আছেন তা জানেন না তিনি। বারবার নিজের মা-বাবার কথা বলছিলেন সদ্য মা হওয়া রোহিঙ্গা কিশোরী নূর বিবি। এমনটাই জানা যায় তার সঙ্গে কথা বলে।
বালুখালী পাহাড়ের চূড়ায় বাশের চাং তৈরি করে, তার ওপর কালো পলিথিন লাগিয়ে নিজেদের জন্য আপাত থাকার জায়গা তৈরি করেছেন নূর বিবির পরিবার। দশ-বাই-পাঁচ হাতের কুটিরে তার সঙ্গে আছেন স্বামী ইয়াসিন আরাফাত। শ্বশুর-শাশুড়ি, তাদের তিন মেয়ে ও চার ছেলে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পরিবারের বড় ছেলে ইয়াসিন। বয়স ২২। রাখাইন রাজ্যে ছেলে ও মেয়েদের কম বয়সেই বিয়ে হয়। ইয়াসিনেরও তাই হয়েছে। মংডুর নাগপুরা এলাকায় ইয়াসিন পানের দোকান আছে। তার বাবা খাইরুল বাশার একজন মৌলভী। মাদ্রসায় আরবি পড়ান।
নূর বিবির শ্বশুর খাইরুল বাশার বলেন,‘আমাদের বাড়ি ছিল মংডুর নাগপুরে। মিলিটারিরা আগুন দিয়ে বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। সবকিছু রেখে পালিয়ে এসেছি। বাংলাদেশে আসার আগে ১৩ দিন কেবল পাহাড় আর জঙ্গলে হেঁটেছি। এরপর বাংলাদেশে এসেছি ৪ সেপ্টেম্বর। তারপর এই পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছি।’
এ সময় নূর বিবির পাশেই বসে ছিলেন তার শাশুড়ি। নূর বিবি কখন মা হয়েছেন জানতে চাইলে তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমাদের ঘর বাড়ি সবই আছে। কিন্তু তারপরও আমার প্রথম নাতনির জন্ম হলো পাহাড়ে। গত সোমবার রাতে নূর বিবির প্রসব বেদনা শুরু হয়। এসময় আমরা খোলা আকাশের নিচেই।’
সে সময়কার পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি আরও বলেন,‘আশেপাশের মানুষরা মাইয়াটার কষ্ট দেখে সহ্য করতে পারছিল না। এখানকার নারীরা সবাই কষ্টে আছেন। কাকে কী বলব! তারপরও অনেকে সাহায্য করেছেন, এগিয়ে এসেছেন। এর কিছুক্ষণ পর মা হয়েছেন নূর বিবি। তারপর গাড়িতে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। সেখান থেকে তিনদিনের ওষুধ দেওয়া হয়েছে।’ তাদের কাছে কোনও টাকা পয়সা নেই বলেও জানান তিনি।- বাংলা ট্রিবিউন
এমটিনিউজ২৪ডটকম/আ শি/এএস