আমানুর রহমান রনি, টেকনাফ থেকে : মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কেউ জানে না, কেন তাদের বাড়ি-ঘরে আগুন দিয়ে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। যে ‘জঙ্গি’দের কথা মিয়ানমার সরকার বলছে, তারা সেই গ্রুপের বা সংগঠনেরও নাম জানেন না।
তারা বলছেন, ‘কোন অপরাধের আমাদের ভিটেমাটি ছাড়া করলো’ আমরা জানি না। শনিবার টেকনাফের লম্বাবাড়ি, উনছি প্রাং, নয়াপাড়া ও উখিয়া উপজেলার পালংখালী, বালুখালী ও কুতুপালং এলাকায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা গেছে।
গত বছরের ২৫ অক্টোবার থেকে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসা শুরু করে। এর আগে গত বছরের ২৪ আগস্ট থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালায়। প্রতিদিনই কোনও না কোনও গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে সেনাবাহিনী।
নয়াপাড়া ক্যাম্পের সামনের সড়কে রহিমা খাতুন নামে এক রোহিঙ্গা নারী তার সন্তান নিয়ে বসে আছেন। স্বামীর নাম নবী হোসেন। রাখাইনের গর্জনদিয়ার পাতন ঝাঁ গ্রামে ছিলেন তারা। তিনি বলেন, ‘আমাদের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে মিলিটারি। বোমা মেরেছে। মানুষ হত্যা করেছে।’
এ সময় এই নারীর চোখেমুখে ছিল আতঙ্ক। তিনি বার বার মিয়ানমার সীমান্তের দিকে হাত দিয়ে দেখাতে থাকেন তার গ্রাম কোন দিকে। তিনি বলেন, ‘সবাইকে গুলি করে। মাটিতে শোয়াইয়া গুলি করে।’
তার দুই ছেলে, দুই মেয়ে ও স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে শনিবার সকালে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন রহিমা খাতুন। কী কারণে মিলিটারিরা আগুন দিচ্ছে? জানতে চাইলে, তিনি বলেন, ‘জানি না, আগুন দেয়, বোমা মারে।’
তিনি এ জন্য মগদের দোষারোপ করতে থাকেন। কোনও বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে চেনেন কিনা, বাড়িতে কখনও আশ্রয় নিয়েছিল কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, চিনি না।’
কথা হয় তার সঙ্গে প্রাণ বাঁচাতে ঘরবাড়ি ও নিজের দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসা আরেক নারী নূর জাহান বেগমের সঙ্গে। তার স্বামীর নাম হোসেন আহমেদ। মংডুর বসরাপাড়া এলাকায় তিনি থাকতেন। কোনও বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে চেনেন কিনা—জানতে চাইলে তিনি উল্টো প্রশ্ন করেন, ‘তারা কারা?’
একই তথ্য মিলে উনচি প্রাং এলাকায় নতুন আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের কাছ থেকেও। সেখানে কথা হয় মোসনা (২০) নামে এক নারীর সঙ্গে। তিনিও আগুন দেওয়ার কারণ খুঁজছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা গরিব। স্বামী দিনমজুর। বাজারে মানুষের কাজ করতেন নিজেও। এরপরও কেন আমাদের বাড়িতে আগুন দেওয়া হলো, বুঝতে পারছি না।’
শনিবার (৯ সেপ্টেম্বর) রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নেওয়া নতুন ক্যাম্পগুলোতে দেখা গেছে, বৃষ্টি কাদা পানিতে তারা দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। দিনরাত খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করতে হচ্ছে এখনও। তাদের খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট রয়েছে। খাবার ও পানির অভাবে পরিস্থিতি আরও জটিল রূপ নিতে পারে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও নারীদের জন্য পরিস্থিতি দুর্বিষহ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
মিয়ানমারের সরকার দাবি করেছে ‘আলকিন’ ও ‘আরসা’র সদস্য তাদের আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর চৌকিতে হামলা করেছে। তবে রাখাইন রাজ্যের সাধারণ মানুষ কেউ এই সংগঠনের নাম শোনেননি।
মংডুর সাহেব বাজার এলাকার বাসিন্দা সৈয়দ নূর হোসেন (২২)। এই তরুণের কাছেও ‘জঙ্গিদের’ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি তাদের চিনি না। কখনও এলাকায় দেখিনি। হামলা করতেও দেখিনি। আমরা যেখানে থাকি, সেখানে মিয়ানমার পুলিশের ক্যাম্প আছে। কখনও তাদের যুদ্ধ করতে দেখিনি। আমাদের সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্ক নেই।’
মংডুর মরিকং এলাকার চেয়ারম্যান জাফর আলম (৪০)। তার বাড়ি নাফ নদী থেকে খুব কাছে। এতদিন তিনি পরিবার নিয়ে বাড়িতেই ছিলেন। যারা বিভিন্ন এলাকা থেকে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে এসেছেন, তাদের তিনি খাবার দিয়েছেন। তিনি ভাবছেন, তার আসতে হবে না।
তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে প্রতিদিনই মিয়ানমার পুলিশ ও মিলিটারির সঙ্গে কথা হয়। তারা আমাকে দিনে থাকতে বলে, রাতের বেলায় গ্রামে আগুন দিয়েছে। এরপর শনিবার ভোরে আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে পরিবার নিয়ে চলে আসি।’
মংডুর মরিকং এলাকার চেয়ারম্যান, ‘আমাদের এলাকায় কখনও বিদ্রোহী, সন্ত্রাসী, জঙ্গি কেউ আসেনি। আমরা চিনি না। আমরা নিরীহ। সবাই কৃষি কাজ করে গ্রামে, কেউ কেউ মাছ ধরে ভাত খায়। সন্ত্রাসীদের কথা বলে আমাদের দেশ ছাড়া করেছে।’ বাংলা ট্রিবিউন
এমটিনিউজ/এসএস