সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:২৬:১১

ক্যাম্পে ঠাঁই নেই, পথে পথে রোহিঙ্গা

ক্যাম্পে ঠাঁই নেই, পথে পথে রোহিঙ্গা

মহিউদ্দিন অদুল, টেকনাফ থেকে : তিন মাসের শিশুকন্যা মোকাদ্দেসা। একটানা কাঁদছে। মা মাহমুদা শিশুর মুখে স্তন দিয়ে ক্ষুধা ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ভান করছিলেন নিজেও স্বাভাবিক থাকার। কিন্তু দোল খাইয়েও শান্ত করা যাচ্ছিল না অবুঝ শিশুটিকে। কারণ মায়ের স্তন থেকে দুধ পাচ্ছিল না শিশু।

মাহমুদা বললেন, তাড়া খেয়ে মৃত্যুর ভয়ে গত ১৫ দিন ধরে খেয়ে-না-খেয়ে আছি। এ অবস্থায় বুকে দুধ পাচ্ছে না শিশুটি। কোনো গুড়ো দুধও দিতে পারছি না। কাঁদতে কাঁদতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে মোকাদ্দেসা।

গতকাল রোববার বেলা ২টা। টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পের রংধনু মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলটির ছোট্ট একটি কক্ষে এভাবেই মাহমুদার কোলে মোকাদ্দেসার দেখা মেলে। সেই কক্ষের পরিবেশ ছিল অসহনীয়। কক্ষটিতে আড়াআড়িভাবে একজনের ওপর আরেকজন করে বসে আছেন। ছোট্ট ওই কক্ষে দুই শতাধিক নারী ও শিশু। ঘামের উৎকট দুর্গন্ধ। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। শোয়ার জায়গা না হওয়ায় ঠিক সেভাবেই চার দিন ও চার রাত ধরে বসে থেকে পার করছেন তারা।

গত পাঁচ দিন আগে বিশ্বখাদ্য কর্মসূচির কর্মীরা তালিকা করার জন্য তাদের সেখানে জড়ো করেছিলেন। নয়াপাড়া ক্যাম্পে লোক সমাগম দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় সে তালিকা অন্যত্র করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সবাইকে সেখানে যেতেও বলা হয়। কিন্তু সেই সুযোগে মাথার ওপর টিনের চালা পাওয়ায় আশ্রয়হীন মানুষগুলো কক্ষটি আর ছাড়েননি।

নাম তালিকায় না উঠলেও কিংবা খাবার খুব একটা না জুটলেও ছায়ার নিচে থাকার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি তারা। ২৫শে আগস্ট থেকে বেশ কিছুদিন খোলা আকাশের নিচে রাস্তা-ঘাট, বিল-ঝিলে বৃষ্টিতে ভেজার কষ্ট থেকে পরিত্রাণের জন্য তাদের সেই কষ্টের অপেক্ষা। এর মধ্যে শনিবার একবেলা ভাত জুটলেও গতকাল দুপুর পর্যন্ত খাবার জুটেনি। সেখানে মানবেতর পরিস্থিতিতে সময় পার করছে মিয়ানমার থেকে শুধু প্রাণ নিয়ে ফেরা রোহিঙ্গা নারী ও শিশুরা।

পাশের কক্ষে গিয়ে দেখা গেলো আরো ভয়াবহ পরিস্থিতি। মেঝে, দু-একটি বেঞ্চ ও জিনিসপত্রের বস্তায় যে যেভাবে পেরেছে আড়াআড়িভাবে বসে আছে। ওই কক্ষে অন্তত ৪ শতাধিক নারী ও শিশুর অবস্থান। কোলে ৬ মাসের সন্তানকে নিয়ে অন্যদের সঙ্গে কোনো মতে বসার সুযোগ পেয়েছেন মংডুর শহরগাঁ থেকে আসা হামিদা।

তিনি বললেন, গত চারদিন এভাবে বসে থেকেই কাটিয়ে দিয়েছি। অসহনীয় গরম। গায়ে গামাছি উঠছে। এক কাপড়ে আছি। গোসল নেই। খাবার নেই। চোখে ঘুম নেই। সব সময় এমন চিল্লাচিল্লি। এখানে রাত-দিন সমান। সবাই ক্লান্ত। পরিশ্রান্ত। একটু আশ্রয় প্রার্থী।

একই অবস্থা দেখা গেলো ওই স্কুলঘরের অপর তিন কক্ষ এবং বারান্দায়। এর চেয়ে দুঃসহ পরিস্থিতি দেখা গেলো ক্যাম্পে ঢুকার পথে মসজিদের পাশের হেফজখানায়। ঘিঞ্জিভাবে সেখানে বসে আছেন শত শত নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ।

শরণার্থী ক্যাম্পের প্রায় প্রতিটি ঘরেই আশ্রয় নিচ্ছেন গত অর্ধমাস ধরে দেশ ছেড়ে আসা রোহিঙ্গারা। নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পের ১১২৬ নম্বর সারির ৬ নম্বর কক্ষে থাকেন ১৯৯২ সালে আসা মোমতাজ। ১৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৫ ফুট প্রস্থের কক্ষটিতে তার সঙ্গে থাকেন স্বামী ছৈয়দ আহমদ এবং তিন ছেলে আনোয়ার, কামাল ও দেলোয়ার।

সেখানে তিনি আশ্রয় দিয়েছেন আরো তিন পরিবারের ২০ জনকে। নিবন্ধিত শরণার্থী হিসেবে পাঁচ সদস্যের জন্য বরাদ্দ পাওয়া রেশন ভাগ করে খাচ্ছেন সেই ২৫ জনে। ফলে গত এক সপ্তাহ ধরে অর্ধাহারে ও অনেকটা নির্ঘুম রাত কাটছে তাদের।

মমতাজ মানবজমিনকে বলেন, আগে প্রতিদিন ভাত ও নাস্তাসহ দিনে ৪ বার খাওয়া হতো। ৫ জনের খাবার ২৫ জনে খেতে গিয়ে একদিনে ২ বেলা খাচ্ছি। যত দিন পারবেন খেয়ে না খেয়ে ওই অসহায় স্বজনদের আশ্রয় দিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ও ব্যক্ত করলেন তিনি।

তার ঘরে আশ্রয় নেয়া স্বামী ছৈয়দ আহমদের খালা মিয়ানমারের উদং থেকে আসা নেছারু বলেন, জন প্রতি ৮ হাজার টাকা দিয়ে গত ২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে ঢুকি। টাকা দিতে না পারায় নৌকা পার করা দালাল আমাদেরকে ২ দিন তাদের ঘরে আটকে রাখে। ভাগিনা ছৈয়দ আহমদ গিয়ে টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনে। তার বাসায় বসার আশ্রয় পেলেও শুয়ে ক্লান্তি ঘোচার সুযোগ মিলছে না।

একই পরিসরের ওই ক্যাম্পের ১০৩৪ নম্বর সারির ১ নম্বর কক্ষে থাকেন ৫ ছেলে এবং স্ত্রী নেছারুকে নিয়ে থাকেন হাশেম। তিনিও ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে আসেন। তার এ টুকুন ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন ৭ পরিবারের ২৭ জন। নেছারু তার ঘরে জড়ো হয়ে বসা আশ্রয় নেয়া স্বজনদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তার জা আল মারজনের পরিবারের ৭, মারজানের মেয়ে উম্মে খাইয়েরের সংসারের ৬ ও ছমিনার ঘরের ৩, বড় ভাই নূর ছালাম, তার মেয়ে হাসিনার পরিবারের ৭ এবং অপর মেয়ে আজিদার পরিবারের ৩ জন। তার ঘরেও তিল পরিমাণ জায়গা নেই।

গতকাল দুপুরে মিয়ানমারের মগনামা থেকে শিলখালী দিয়ে নাফ পেরিয়ে টেকনাফের কানজরপাড়া দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেন জাহেদ হোসেন। বাম হাতে গুলিবিদ্ধ মংডুর মগনামাপাড়ার জাহেদের সঙ্গে রয়েছে ৮ সন্তানসহ ১৩ জন। তার ঘর পুড়িয়ে দিলে ৮ মাসের কোলের শিশু সাহানুর জীবন্ত দগ্ধ হয়। বাকিদের নিয়ে তিনি এসে ওই ক্যাম্পের প্রবেশ পথেই বসে পড়েন।

তিনি বলেন, কিছুক্ষণ আগে প্রাণ নিয়ে বাংলাদেশে আসতে পেরেছি। বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে, দুর্গম পথে বোঝা ও শিশুদের নিয়ে যে কষ্ট পেয়েছি তা বোঝানো যাবে না। এখন কী করবো, কোথায় যাবো তার কিছুই জানি না।
পাশে দাঁড়ানো পরিবারের ৭ জনকে হারানো দংখালীর রফিক বলেন, আমাদের কারো কোনো আশ্রয় নেই। আমরা ক্যাম্পের বাইরে ঢালুতে একটি ত্রিপল টানিয়ে বাকি ৮ সদস্য আশ্রয় নিয়েছি।

শুধু শরণার্থী ক্যাম্প বা কক্ষ নয়। নিবন্ধিত অপর কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প এবং অনিবন্ধিত বালুখালী, লেদা, শামলাপুর শরণার্থী ক্যাম্পেও উপড়েপড়া ভিড়। ক্যাম্পের রাস্তার পাশে, ক্যাম্পের বাইরের ঢালুতে, খালি পাহাড়ে, খালি জায়গায়, সমতল জমিতে, রাবার বাগানে, খোলা মাঠে, রাস্তার পাশে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, স্থানীয়দের বাড়ির উঠানে, দোকানের সামনে, ঘরে ঘরে, পথে পথে মানুষ আর মানুষ। টেকনাফ-উখিয়াজুড়ে রাস্তায় রাস্তায় আশ্রয়হীন রোহিঙ্গাদের মিছিল। পথে পথে জড়ো হয়ে বসে আছেন পরিবারগুলো।

অনেকের মাথায় একটি পলিথিনের ছাউনি জুটেছে তো অনেকের জুটেনি। শিশু-বৃদ্ধসহ সবাই বৃষ্টিতে ভিজছে। রোদে পুড়ছে। অনেকে দলে দলে মানুষ কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে জড়ো হচ্ছে। কারও গাড়ির জন্য অপেক্ষা। গাড়িগুলো পশুর মতো করে বহন করছে মানুষ। কেউবা হেঁটেই বিভিন্ন দিকে রওনা দিচ্ছেন। কিন্তু কেউ জানে না তাদের গন্তব্য কোথায়? এমজমিন
এমটিনিউজ/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে